প্রজন্মের মননে নজরুলের দ্রোহ

অবিচার, নিপীড়ন ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি ও জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার প্রয়োজন হলেই এ দেশের মানুষ শরণাপন্ন হয় নজরুলের গান, কবিতা, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় ও ব্যক্তি জীবনের নানা কর্মকাণ্ডের। ঠিক বিপরীত দিকে অন্যায়কারী, জুলুমবাজ, পরাধীনতায় বিশ্বাসী ও স্বৈরশাসকেরা সবসময় সতর্ক থাকে, মানুষ যেন নজরুল চর্চার সুযোগ না পায়। কেননা নজরুল চর্চা মানেই ক্ষমতার মসনদ কেঁপে উঠা।

নজরুলের লেখনী পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তির আকাঙ্খায় স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, প্রেরণা জুগিয়েছিল একাত্তরে এবং ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে। জুলাই আন্দোলনে নজরুলের নাম অনিবার্যভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী সংস্কারেও তিনি অনুপ্রেরণার বাতিঘর।

আমরা দেখি, স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো জনকল্যাণে কাজ করেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমল ও পাকিস্তান সামরিক শাসনামলে এ দেশের মানুষ নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। স্বাধীনতার পরও সরকারগুলো বৈষম্য, স্বৈরশাসন, বাকশাল ও গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। তখন মানুষ মুক্তির দিশা খুঁজে পায় নজরুলে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া অহিংস ছাত্র আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই সরকারের দমন-পীড়ন ও একগুঁয়েমির কারণে সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট শাসন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বিস্ময়করভাবে, প্রায় শতবর্ষ পূর্বে রচিত নজরুলের গান ও কবিতাই হয়ে ওঠে এই প্রজন্মের তরুণদের প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা ও হাতিয়ার। 

ছাত্র আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজপথ—সর্বত্রই ছিল নজরুলের উপস্থিতি। 'বিদ্রোহী' কবিতার অমর পঙক্তি—বল বীর, বল উন্নত মম শির! প্রতিটি প্রতিবাদী তরুণের আত্মসম্মান ও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মুখে অটল থাকার ঘোষণায় পরিণত হয়। নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা বিপ্লবীদের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। চির উন্নত মম শির—শিক্ষার্থীদের বিপ্লবী হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আবু সাঈদ তার ফেসবুকে লেখেন 'চির উন্নত মম শির'। সেদিনই সকাল থেকে ফ্যাসিস্ট পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আন্দোলন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলে আবু সাঈদ ও তার সহযোদ্ধারা নজরুলের মতো বলে ওঠেন, 'আমি মানি নাকো তাহার আইন'।

ব্রিটিশদের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিলেন নজরুল। কারারুদ্ধ করা হলেও তিনি থামেননি। ঠিক তেমনি আবু সাঈদকেও আটকে রাখা যায়নি—বুক পেতে দিলেন, কিন্তু ফ্যাসিস্টের আইন মানেননি। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর সারা দেশে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি হলো। সেসব গ্রাফিতিতে ঠাঁই পেলো আবু সাঈদের দু'হাত প্রশস্ত করে গুলির সামনে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা এবং পাশে লেখা 'চির উন্নত মম শির' ও 'আমি মানি নাকো তাহার আইন'।

আন্দোলনকারীরা নজরুলের মতোই ঘোষণা করেছে, 'আমি দুর্বার,/ আমি ভেঙে করি সব চুরমার!/আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,/আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/আমি মানি না কো কোন আইন,/ আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!' তাদের এ ঘোষণার পর ফ্যাসিস্টদের বানানো আইন ও নিয়মকে তোয়াক্কা করেনি আর কেউ। ফলে কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমেছে জনতার ঢল।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আঁকা গ্রাফিতি পরিদর্শন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর ইতিহাসে অভ্যন্তরীণ কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে এত স্বল্প সময়ে আর কোথাও এতবেশি নির্মম হত্যা আর কোথাও হয়নি। কিন্তু তরুণরা ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ী।

যখন সারাদেশে শিক্ষার্থীদের হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার ও মামলা দিয়ে নাস্তানাবুদ করা হচ্ছে, তখন দাবানলের মতো এলো নজরুলের 'আজি রক্ত-নিশি-ভোরে একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে/ ঐ কাহারা কারাবাসে মুক্তি হাসি হাসে,/ টুটেছে ভয়-বাধা স্বাধীন হিয়া-তলে।' ১৮ জুলাই সারাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং ওইদিন আসিফ ও মুগ্ধসহ প্রায় অর্ধশত শহীদ হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে ১৯ জুলাই থেকে গানটির 'ওরা দু'পায়ে দলে গেল মরণ-শঙ্কারে/ সবারে ডেকে গেল শিকল ঝঙ্কারে,/ বাজিল নব-তলে স্বাধীন ডঙ্কা রে,/ বিজয়-সঙ্গীত বন্দী গেয়ে' চলে'/ বন্দীশালা মাঝে ঝঞ্ঝা প'শেছে রে উতল কলরোলে' সমবেত কণ্ঠে বেজে উঠল। দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা হলো নতুন গ্রাফিতি।

পুরো দেশটা একটা কারাগারে পরিণত করে জাহান্নামরে মতো ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল ফ্যাসিস্টরা। ছাত্ররা গেয়ে উঠল, 'কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/ রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী…'। এ গানটির ওপর ভিত্তি করে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে শিক্ষার্থীরা।

কেমন যেন 'বহু যুগের ওপার হতে' শক্তি হয়ে, প্রেরণা হয়ে, বিদ্রোহীর কেতন হয়ে জুড়ে গেলেন নজরুল। বিপ্লবীদের ধমনীতে বইতে লাগল ক্রোধ আর দুর্দম প্রতিরোধের স্রোত।

ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্বিচার গুলি, হত্যা, গুম, হামলা ও মামলায় যখন সবাই দিশেহারা, তখনও বিপ্লবীদের জাগিয়ে তোলের মন্ত্র আসে নজরুল থেকে। 'রৌদ্র-দগ্ধের গান'। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সম্মিলিতভাবে গেয়ে উঠল, 'এবার আমার জ্যোতির্গেহে তিমির প্রদীপ জ্বালো ।/আনো অগ্নিবিহীন দীপ্তিশিখার তৃপ্তি অতল কালো।/ তিমির প্রদীপ জ্বালো।' পথে পথে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে তারা স্লোগান দিতে লাগলো, 'লেগেছেরে আগুন লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে।'

পুরো দেশটা একটা কারাগারে পরিণত করে জাহান্নামরে মতো ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল ফ্যাসিস্টরা। ছাত্ররা গেয়ে উঠল, 'কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/ রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী…'। এ গানটির ওপর ভিত্তি করে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে শিক্ষার্থীরা।

অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার হাজারো ছাত্র-জনতার মুক্তির দাবিতে এবং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে 'কারার ঐ লৌহকপাট'। রাজপথে পুলিশের বাধার মুখে, এমনকি কারাগারে আটক বিপ্লবীরাও এই গান গেয়ে উঠেছেন। দেশের সব জনপদে নজরুলের বিভিন্ন গানের শব্দে ও সুরে মানুষের ভেতরের সুপ্ত চিন্তা দৃঢ় হয়েছে।

আন্দোলনকারীদের মনোবল চাঙ্গা থেকেছে নজরুলের গান ও কবিতায়। তারা গেয়ে উঠল 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীতে যাত্রীরা হুশিয়ার!'

স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া বাহিনীর গুলির মুখে দাঁড়িয়েও যখন ছাত্র-জনতা পিছু হটেনি, তখন নজরুলের 'চল্ চল্ চল্' গানটি মিছিলে মিছিলে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। একইভাবে 'মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম/ মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল' গানটি তরুণ বিপ্লবীদের অদম্য শক্তি ও বাঁধনহারা চেতনার প্রতিধ্বনি হয়ে বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

যখন শাসকগোষ্ঠী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে, সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার পাঁয়তারা করেছে, তখন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নজরুলের 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতাটি। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে বলে ফ্যাসিস্টরা যখন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের রূপ দিতে চাইলো, তখন ছাত্র-জনতা গেয়ে ওঠে—

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,

কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ!

'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বল ডুবিয়াছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!"

পঙক্তিগুলো শুধু রাজপথের স্লোগান বা দেয়াল লিখনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্থাপিত 'স্বাধীনতা স্কয়ারে' খোদাই করে রাখা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার রক্তে যখন রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, তখন এই পঙক্তিগুলো হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদকামীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী জবাব।

হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট যখন স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো, দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো, তখন প্রতিধ্বনিত হলো—

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে-

মোর মুখ হাসে চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।

জুলাই আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করে তারা বিজয় ছিনিয়ে আনে। 'আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল।/ মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান/ উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল' নজরুলের এই কবিতাটি যেন তাদের অপরিহার্য ভূমিকারই প্রতিচ্ছবি।

বাবা-মায়েরা যখন ভয় পেয়ে আন্দোলনে যেতে শিক্ষার্থীদের বারণ করে, তখন তারা নজরুলের ভাষায় বরেছিলেন, 'আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক/ হয়নি সকাল, তাই বলে কি সকাল হবে না কা!/আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?/তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!' লাইনগুলো যখন শিক্ষার্থীরা গ্রামে-গঞ্জে, শহরের দেওয়ালে গ্রাফিতিতে তুলে আনলো, তখন আর বাবা-মায়েরাও বসে থাকেনি। সন্তানদের সঙ্গে মাঠে এসেছেন, নিজ হাতে শিক্ষার্থীদের পানি, খাবার খাইয়েছে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ কাজী নজরুল ইসলামকে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষে পরিণত করেছে। তার 'বিদ্রোহী' সত্তা কোনো একক নেতা বা শক্তির অন্ধ অনুকরণের ঘোর বিরোধী। এ কারণেই ২০২৪ সালের স্বৈরাচারবিরোধী জুলাই আন্দোলনেও তিনি এত প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম কেবল একজন কবি নন, তিনি বাংলা ও বাঙালির শাশ্বত বিদ্রোহের এক জীবন্ত প্রতীক, চেতনার বাতিঘর। যতদিন পৃথিবীতে অন্যায় থাকবে, অসাম্য থাকবে, ততদিন নজরুলের বিদ্রোহের আগুন জ্বলবে মানুষের হৃদয়ে প্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে। তার ভাষায়, 'আমি সেই দিন হব শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।' আর সেই দিন না আসা পর্যন্ত নজরুল থাকবেন প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে রসদ জুগিয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান। তার চিহ্ন দেশে আনাচে-কানাচে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে ফুটে উঠেছে। টিকে থাকুক নজরুলের এই অনুপ্রেরণা, যেন আর কেউ ফ্যাসিস্ট হওয়ার সাহস না করে।

সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

Comments

The Daily Star  | English

Not going anywhere till the job is done: Adviser Wahiduddin Mahmud

When asked about the chief adviser's resignation the adviser said, 'But he did not say he was leaving'

8m ago