প্রসঙ্গ ময়ুখ চৌধুরী

সাহিত্যে পুরস্কারের রাজনীতি

ময়ুখ চৌধুরী (আনোয়ারুল আজিম, জন্ম: ২২ অক্টোবর ১৯৫০)

ময়ুখ চৌধুরী এই সময়ের কবিতার দেদীপ্যমান মুখ ও প্রতিভাবান কবি। কিন্তু সব থেকে অবহেলিত। রাষ্ট্রের কোন উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পাননি। এমনকি ব্যক্তিখাতের যেসব প্রতিষ্ঠান শিল্প-সাহিত্যে পুরস্কার দেন, তাদের থেকেও বঞ্চিত, উপেক্ষিত। অথচ উনার কবি-প্রতিভা প্রশ্নাতীত।

একুশে পদক পাওয়া একজন শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার এই পদক এতদিন না পাওয়ায় কোন ক্ষোভ ছিল কী? বলেছিলেন, ক্ষোভ না থাকলেও একটা দুঃখবোধ ছিল। কারণ আমার চেয়ে কম যোগ্য বা অযোগ্য ব্যক্তিও এই পুরস্কার পেয়েছেন, তা হলে আমি কেন নয়? ময়ুখ চৌধুরী অবশ্য এভাবে ভাবেন না। উনি মনে করেন, পুরস্কার নিয়ে ভয়াবহ রাজনীতি এখানে। এ কারণে অযোগ্যরাই এগিয়ে থাকে। চাটুকার, দলদাস, ব্যক্তিত্বহীন, অ-বুদ্ধিজীবীদের পুরস্কার ভাগ্য সবসময়ই ভাল হয়। এ কারণে পুরস্কার নিয়ে আমি কখনো আগ্রহী নই। বরং পুরস্কারের প্রতি আমার করুণা কাজ করে। 

এই যে, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পেলাম, সৃজনশীল শাখায় আমার 'অনিদ্রার কারুকাজ' কাব্যগ্রন্থের জন্য। এর জন্য সত্যিই আমি আনন্দিত নই, উল্টো ভীষণভাবে বিব্রত। এখন আপনি বলতেই পারেন এই পুরস্কার তা হলে আমি কেন নিলাম? আমি শুধু আমার মেয়ের জন্য নিয়েছি। আর আমার কয়েকজন ভক্ত-অনুরাগীর জন্য। যারা খুশী হন এই পুরস্কারটা নিলে। ওঁদেরকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। 

আনন্দযজ্ঞ বুঝি আরও রোশনা পেল ময়ুখ চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের আড্ডা ও আলাপে। উনি কারওয়ান বাজারের অভিজাত এক হোটেলে পুরস্কার গ্রহণ করে সরাসরি চলে আসেন ডেইলি স্টার ভবনে। সঙ্গে ইমরান মাহফুজ, কবি মামুন মোস্তফা, প্রকাশক মঈন ফারুকসহ আরও কয়েকজন। অপেক্ষারত ছিলাম আমি ও সাংবাদিক ইয়াসির আরাফাত। কথাসাহিত্যিক ফয়সাল আহমেদ জরুরি কাজের জন্য বিদায় নিয়েছেন। কবি তখন বেশ আলাপী মেজাজে। উত্তরীয়, শংসাপত্র ও সম্মাননা স্মারক দেখে আমরা আনন্দিত হলাম। আলাপ এগোল উত্তরীয় ধরে।  

উনি বললেন উত্তরীয় এসেছে উত্তর প্রদেশ থেকে। স্তন ঢেকে রাখার জন্য মেয়েদের এটা পরানো হত। উত্তরীয় অর্থাৎ উপরের অংশ। সেই সময় মেয়েদের নীচের অংশ ঢেকে রাখার অধিকার ছিল, উপরের অংশ নয়। শুধুমাত্র ব্রাক্ষ্মণ মেয়েরা উপরের অংশও ঢেকে রাখতে পারত। ওঁদের উপরের এই কাপড়কে বলা হত উত্তরীয়। তারপর সেই উত্তরীয় ব্রাক্ষ্মণত্বের প্র্রতীক হয়ে এখনও আমাদের গলায় ঝুলছে, আজ ঝুলিয়েছি আমি। প্রসঙ্গক্রমে এটা নিয়ে নির্মিত সিনেমা 'মুলাক্কারম' দেখার কথা বললেন। 

আমরা বললাম এটাতো ঐতিহাসিক ঘটনা। স্তন কর বা ব্রেস্ট ট্যাক্সকে 'মুলাক্কারম' বলে মালয়লাম ভাষায়। সেই স্তন করের সত্য কাহিনি নিয়ে সিনেমাটা নির্মিত হয়েছে। ঘটনাটা কেরালার নাঙ্গেলী নামের এক মেয়ের। যে স্তন করের প্রতিবাদে নিজের দুই স্তন কেটে কর আদায়কারীর হাতে তুলে দিয়েছিল। স্তন কর থেকে আমাদের বাহাস, কথার তুবড়ি ছুটিয়ে অশ্বগতিতে এগোতে থাকে। 

ঘুরে ফিরে এল বাংলা একাডেমি ও তার পুরস্কার প্রসঙ্গ। সেই সূত্রে হাজির হলেন কবি জসীমউদ্দীন ও সমসাময়িক আরও কয়েকজন কবি। খোলতাই করলেন বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র এবং কবি কবিতার রাজনীতি। তিনি বললেন, ১৯৬১-তে প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। আমরা বললাম ১৯৬০-এ। ওই বছর পান ফররুখ আহমদ। তার পর এল আহসান হাবীব, সানাউল হক খান, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, সুফিয়া কামাল, তালিম হোসেন, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান প্রমুখের নাম। এভাবে ১৯৭৬ অবধি, উল্লেখযোগ্য-অনল্লেখযোগ্য অনেকেই পেলেন। কেবল জসীমউদ্দীনকে দেয়া হল না বাংলা একাডেমি পুরস্কার।

তিনি প্রশ্ন রাখলেন তাতে কি বাংলা একাডেমির পুরস্কারের মান কমেছে না বেড়েছে? ওই প্রতিষ্ঠানটি জানে না, পুরস্কার কেন দেয়া হয় আর কেন দেয়া হয় না। জসীমউদ্দীনের সূত্রে হাজির হলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। একাডেমিতে চাকরি করলেই পুরস্কার ভাগ্য খুলে যায়। আর তখন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ওই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হয়েও পুরস্কার পাননি। গীতিকার হিসেবে খ্যাতির এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন যে, আবু হেনার কবি প্রতিভাকে আমলে নেয়ার প্রয়োজনই মনে করেননি পুরস্কার কমিটি।

আমরা বললাম, গীতিকবি হিসেবেই না হয় উনাকে সম্মানিত করতে পারতেন। বব ডিলান যদি এই প্রতিভাগুণে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, তা হলে উনার ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? উনি স্মরণ করালেন, 'গীতাঞ্জলি'র কথা। ওটাতো মূলত গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গীতিকবিতার জন্য নোবেল পেয়েছেন। বব ডিলানকে গীতিকবি হিসেবে পরিচিতি দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে। এটুকুই পার্থক্য, আর কিছ নয়।

ময়ুখ চৌধুরী জানালেন, জসীমউদ্দীনের কবি-প্রতিভা অনেকের কাছে ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। বাংলাদেশের কবিতার প্রতিভূ বলতে সর্বাগ্রে এবং প্রধানত জসীমউদ্দীনকেই বোঝায়। উনি এই দেশটাকে রচনা করে গেছেন। বাংলাদেশটাকে দেখতে হলে উনার কবিতার কাছে ফিরে যেতে হবে। জসীম উদ্দীন একবার শামসুর রাহমানকে বলেছিলেন, উনি পৃথিবীর শেষ কবি। কথাটা মনে রেখেছিলেন। 

কেন শামসুর রাহমানের আগে আল মাহমুদকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হল, তার যুক্তিও দিলেন ময়ুখ চৌধুরী। আমরা জানলাম এর পেছনে সৈয়দ আলী আহসানের কথা। যার কারণে শামসুর রাহমানের আগে আল মাহমুদ পান এই পুরস্কার। ১৯৬৮, আর ১৯৬৯-এ। উনি মনে করেন, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের দলাদলি ও রাজনীতি স্বাধীনতার আগেই শুরু হয়। সময় পরিক্রমায় তা এখন অতিমাত্রা পেয়েছে। যুক্ত হয়েছে নোংরামি, নির্লজ্জতা, পরশ্রীকাতরতা আর অযোগ্যদের অসহনীয় ও দৃষ্টিকটূ উল্লম্ফন। 

আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ কতোটা ভেতর থেকে পচে গেছে এদের ভালভাবে না দেখলে টের পাওয়া সহজ নয়। একারণে বাংলা একাডেমির ডিজি তিনিই হন, যার আদ্দিষ্ট হয়ে কাজ করার যোগ্যতা আছে। শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিতে এসব থাকলে সৃষ্টিশীল কিছু হয় না। আমাদের এখানে সৃষ্টি ততটা হচ্ছে না, শয়তানিটা হচ্ছে যতটা। এসব বোঝাতে প্রতীকি এক গল্পের আশ্রয় নিলেন কবি।

এখানে পাঁচজন কবি বা গল্পকার একত্রিত হলে তাতে মুখ্য বিষয় থাকে পরনিন্দা। তারপর একজন চলে গেলে, বাকী চারজন উনাকে নিয়ে গালমন্দ  করেন। চতুর্থ জন যাওয়ার পর একই কাজ করেন বাকী তিনজন। এর পর তৃতীয় জন আর উনাদের রেখে যেতে চান না। কারণ একটাই, চলে যাওয়ার পর বাকী দুইজন উনাকে নিয়ে গালি-গালাজ শুরু করবেন। এই বাস্তবতায় শিল্প-সাহিত্যের অভীষ্ট গমন হবে কীভাবে? এ কারণে আমরা কমপক্ষে একশ বছর পিছিয়ে, এমনকি কলকাতার চেয়েও।

ময়ুখ চৌধুরী মনে করেন বাংলা বর্ণমালা থেকে কিছু অক্ষর কমানো প্রয়োজন। এগুলো না থাকলে বাংলা শব্দ তৈরি ও বাক্য গঠন হবে আরও বেশি সহজ ও ঝামেলামুক্ত। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারকে আরও বেশি আধূনিক, নির্ঝঞ্ঝাট করতে হলে এখন সময় এসেছে বর্ণমালা কমানোর। এতে নতুন শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে অন্যভাষার শিক্ষার্থীদের কাছে এবং দেশের শিশু-কিশোরদের কাছে বাংলায় পঠনপাঠন ও লেখালেখি হবে ঝক্কিবিহীন ও আনন্দময়। কিছু বর্ণ একাধিক থাকায় নতুন শিক্ষার্থীরা শেখার শুরুতেই কেবল বাধাগ্রস্ত না বিভ্রান্তও হয়। উনার প্রস্তাব হল :

এক. শ, ষ, স এই তিনধরণের স-এর মধ্যে শুধু একটা এবং সেটা 'স' থাকাটাই যুক্তিযুক্ত ও বাঞ্ছনীয়। দুই. ত. ৎ-এর ক্ষেত্রে উনার বক্তব্য হল কেবল 'ত' থাকুক। এই 'ত' দিয়েই সম্ভব ত ও ৎ-এর কাজ চালিয়ে নেওয়া। উনি মত ও মত-ওকারান্ত উচ্চারণ সহ এবং মম ও মম এর পার্থক্য বুঝতে চান। উনি বলেন এক মম-তে আমার হয় আরেক মম হল, সমারসেট মম। কেউ লেখেন মম আবার কেউ লেখেন মম্। এই জাটিলতা কীভাবে নিরসন হবে।

রাত্রি ১২টা ছুঁইছুঁই। ডেইলি স্টার ভবনেও মধ্যরাত্রির নিরবতা নেমে এসেছে। তখনো চলছে আড্ডা।

তিন. ই ও ঈ এবং উ ও ঊ-এর ক্ষেত্রে উনার অবস্থান কেবল ই এবং উ-কার থাকলেই চলবে। ঈ-কার ঊ-কার থাকার দরকার নেই। যুক্তি হল আমরা তো উচ্চারণের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করি না। তা হলে কেন আমরা তাদেরকে বহন করে চলেছি? কোথাও যদি এদের ব্যবহারের কোন বিকল্প না থাকে, তা হলে দুটো ই-কার ও দুটো উ-কার ব্যবহার করলেই হবে। ঈ-কার ও ঊ-কারের প্রয়োজনীয়তা নেই, যুক্তিযুক্তও নয়।

চার. উনি বলেন, ন-তে এক অর্থে তিনটা। ণ, ন ও ঞ। যেমন আমরা বলছি ঝঞ্ঝা, এখানে কিন্তু ঞ হয়ে যাচ্ছে ন বা ণ।

এসব নিয়ে আমরা দ্বিমত হই। যুক্তি দেই। আমরা বলি এসব ভাষার শক্তি। ইংরেঝি বর্ণেওতো তিনটা জি রয়েছে; জি, জে ও জেড। এসব তো ওই ভাষার শক্তি। এসব কমানোর প্রস্তাব কি যুক্তিযুক্ত হতে পারে? ঞ এর ক্ষেত্রে এই ন কিংবা ণ এর প্রয়োগ কিন্তু তার বর্গের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ চ বর্গের ক্ষেত্রে সে তার স্বাতন্ত্যটা বজায় রাখতে চায়। এই যে, অঙ্ক শব্দে ঙ কাজ করছে ভূমিকায়। এটাও কিন্তু ওই বর্গের ক্ষেত্রেই শুধু প্রযোজ্য। এগুলো কি সেই ভাষার শক্তি না দূর্বলতা। উনাকে বলি আপনার প্রস্তাব আগেও কয়েকজন দিয়েছেন। বিশেষ করে ইব্রাহীম খাঁ ও আবুল মনসুর আহমদ। কিন্তু এই প্রস্তাব কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?

ভাষার ভেতরে যত বৈচিত্র্য থাকবে সেটা তো ওই ভাষার শক্তিকেই প্রকাশ করবে। আর এই শক্তি প্রকাশিত হয় তার বর্ণের ভেতর দিয়ে। ফলে, বর্ণসংখ্যা যত বেশি থাকবে সেই ভাষার বহুমাত্রিকতা ততভাবে প্রকাশিত হবে। এ ছাড়া মানুষের যেমন বংশ পরিচয় আছে, বর্ণের কিন্তু রয়েছে পরিচয়। আছে আমাদের মত তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এখন বর্ণকে যদি কমিয়ে ফেলা হয়, তা হলে তো তার বংশ পরিচয়ে গোলমাল দেখা দেবে, এটা কি যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করেন? এই যে, দ্বিতীয় শব্দে 'দ' এর নীচে যে ব, সে কিন্তু উচ্চারিত হয় না। কিন্তু তাকে অস্বীকার করা যাবে না। খেয়াল করেন স্যার ব কিন্তু two-তেও রয়ে গেছে। এখানে w, সেও কিন্তু উচ্চারিত হয় না। কিন্তু তার অস্তিত্বকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। সেটা করতে গেলে ঠিকুজিতে টান পড়বে। কারও ঠিকুজি ধরে টান দেওয়াটাকে কি আপনি অন্যায়-অপকর্ম বলে মনে করেন না?

কবি শব্দের ব্যবহারের দিকে আলাপ এগিয়ে নেন। বলেন, আমরা বলি সে বসে পড়ল। বসে আবার পড়ে কীভাবে? বসে আবার পড়ে কীভাবে? বসে বললেই হয়, নাকি? আবার বলা হয়। সে উঠে দাঁড়াল। উঠে আবার দাঁড়ায় কীভাবে? উনি বলেন, এসব দেখে-শুনে বিদেশিরা হাসাহাসি করেন। বলেন, তোমাদের শব্দের আগা-মাথা বুঝি না। আমরা বলি, স্যার বিদেশিদের কি না বোঝাই কি স্বাভাবিক নয়। আমাদের ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতির কয়েক হাজার বছরের প্রবহমানতা, আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশ ও ভূগোল সম্পর্কে যদি ন্যূনতম ধারণা না থাকে তা হলে বাংলা ভাষার এলানো প্রবণতা বোঝা সম্ভব নয়। যে কোন ভাষার অন্তর্নিহিত রহস্য ও তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা বৈশিষ্ট্য তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে চাওয়া যুক্তিযুক্ত কী?

বাংলা ভাষাটা কোন বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয়নি। বিদ্বৎজনের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। আবার সংস্কৃতের মতো অন্যভাষার সংস্কার থেকে উদ্ভূত নয়। বাংলা ভাষা পৃথিবীর আদি ভাষাগুলোর অন্যতম। এর জন্ম মানুষের মুখে মুখে। কোন্ সে মানুষ। যারা নিচুতলার এবং সমাজের প্রান্তিক অংশ। নদীর পাড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে, বন-জঙ্গলের কাছাকাছি, কিংবা নদীতে-পাহাড়ে-বনে জঙ্গলে ছিল তাদের বসবাস। আমরা তাদের উত্তরাধিকার। এই যে, যে মানুষগুলো এখনও শূকর চরিয়ে বেড়ায়, কচ্ছপ শিকার করে, মধু সংগ্রহে নিয়োজিত, নদীতে নদীতে ভেসে সাপের কারবারি করে, মাছ ধরে, বন্য প্রাণী শিকার করে, গরু-মহিষের বাথানি যাদের কাজ, যারা তাঁত বুনে, যারা কৃষিকাজ করে-আমরা এঁরাই। ওঁদের মুখেই জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষার। 

সেদিনের সেই প্রাচীন বাংলায় সারাদিনের পরিশ্রম শেষে যখন তারা গল্প শোনাত আপনজনদের গোত্রভূক্তদের। তখন সে গল্পকে তারা প্রলম্বিত করতে চাইত, বন্য পশু শিকারের আগে-পরে প্রার্থণা করার মত। তাতে রসের প্রলেপ দিত, ঠিক নদীতে যেভাবে আসে ঢেউ। একারণেই বাংলা ভাষার এই এলায়িত প্রবণতা। এর মধ্যে আমাদের অতীতের জীবনাচার ও রোজনামচা রয়েছে। আমাদের নদী-বন-জঙ্গল-পাহাড়-খাল-বিল-পশু-পাখি-প্রাণী-বৃক্ষ–লতাপাতা-উদ্ভিদ-কীটপতঙ্গ সবার অদৃশ্য উপস্থিতি রয়েছে। একারণেই আমরা বলি উঠে দাঁড়ালাম। বসে পড়লাম। এখন এই এলায়িত ভঙ্গিকে আপনি ব্যাকরণের দোহাই দিয়ে কাটছাট করতে পারেন। শুদ্ধতার নামে তার অপসারণ ঘটাতে পারেন। তাতে হয়তো ব্যাকরণ মানা হবে, কিন্তু বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাসটা অবলুপ্ত হবে। 

বাহাস চলতে থাকে, আমরা ঘন হয়ে বসি। কবির কথার জাদুতে নানা ঘাটে নোঙ্গর ফেলতে থাকেন কুশলী এক নাবিকের মতো। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ হয়ে সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, সুফিয়া কামাল, সানাউল হক খান, আব্দুল গনি হাজারী প্রমুখের জীবন ও কর্মে। কোথাও ভাল লাগা, কোথাও মন্দ লাগা, কোথাও প্রশ্ন হাজির করা-এভাবেই চলতে থাকে আমাদের আলাপ।

আব্দুল গনি হাজারী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাল কিছু একটাই যথেষ্ট। গুলি হাজারটা করা লাগে না। 'কতিপয় আমলার স্ত্রী' কবিতায় যথেষ্ট উনাকে বাঁচিয়ে রাখতে। একসময় হাজির হল, আনিসুজ্জামানের গদ্য প্রসঙ্গ। উনি বললেন, আবু হেনা মোস্তফা কামালের গদ্য আলঙ্কারিক। আনিসুজ্জামানের গদ্য নির্মেদ। উনার মতো সহজ ভাষার গদ্য সম্ভবত আর কেউ লিখতে পারেননি। যেখানে আগে লিখলে হয়, সেখানে উনি কোনভাবেই পূর্বে লিখেননি। আসলে যার মাথা যত পরিস্কার, তার গদ্য তত পরিস্কার।

আমরা বললাম, আনিসুজ্জামানের গদ্য কি তা হলে সাংবাদিকতার গদ্য? সাংবাদিকতার গদ্য ও সাহিত্যের গদ্যের মধ্যে নিশ্চয় ফারাক আছে। আবার সাহিত্যিক গদ্যের মধ্যে গল্প-উপন্যাসের গদ্য একরকম, আত্মজীবনী-স্মতিকথার গদ্য আরেকরকম, প্রবন্ধ-গবেষণার গদ্য এদের থেকে আলাদা। এখন সহজ, নির্মেদ করতে গিয়ে সেই গদ্য এসব প্রকারভেদের বাইরে গিয়ে একইরকম হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকতার গদ্য যেরকম হয়। 

'জসীমউদ্দীনকে জাতীয় কবি করা হোক'। শিরোনাম দেখেই তিনি বললেন, এই দাবিটা যৌক্তিক। এটা পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা উচিত। কারণ জসীমউদ্দীনই বাংলাদেশের জাতীয় কবির মতো কবিতা ও গান লিখেছেন।

বই প্রকাশ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বই যত দেরিতে-রয়ে সয়ে প্রকাশ করা যায়, তত ভাল। আমরা বলি, কেবল এদেশেই সম্ভবত বইয়ের সংখ্যা দিয়ে লেখকের মান বিচার করা হয়, লেখকের আমলনামা হিসেবে দেখানো হয়। উনি বলেন, খেয়াল করবেন বেশীর ভাগ কবি-সাহিত্যিক কিন্তু নিজেদের প্রথম বইয়ের কথা আড়াল করেন। ভাল জিনিস কম পয়দা হয় এবং সময় নিয়ে হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সম্ভবত এই সত্য জানে না, মান্যতা দেয়ার যোগ্যতা রাখেন না।

কালের ধ্বনির ‘বাংলাদেশের কবিতার ৫০ বছর’ (আশিক রেজা ও ইমরান মাহফুজ সম্পাদিত)

তখন রাত্রি ১২টা ছুঁইছুঁই। ডেইলি স্টার ভবনেও মধ্যরাত্রির নিরবতা নেমে এসেছে। ইমরান মাহফুজ উনার হাতে এরই মাঝে তুলে দিয়েছেন কালের ধ্বনির 'বাংলাদেশের কবিতার ৫০ বছর' (আশিক রেজা ও ইমরান মাহফুজ সম্পাদিত) সংখ্যাটি। খুঁটিয়ে দেখছেন তার সূচী। 'জসীমউদ্দীনকে জাতীয় কবি করা হোক'। শিরোনাম দেখেই তিনি বললেন, এই দাবিটা যৌক্তিক। এটা পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা উচিত। কারণ জসীমউদ্দীনই বাংলাদেশের জাতীয় কবির মতো কবিতা ও গান লিখেছেন। পরক্ষণেই প্রশ্ন রাখলেন, কিন্তু একজন জাতীয় কবি তো রয়েছেন, তা হলে উনাকে কীভাবে জাতীয় কবি করা সম্ভব? 

আমরা বললাম, জাতীয় কবি একাধিক হতে পারে, সেই বিবেচনায়। উনি বললেন, তা ঠিক। জাতীয় অধ্যাপক যদি একাধিক হতে পারে, তা হলে জাতীয় কবি কেন নয়? আমরা বললাম, তা ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় কবি একাধিক রয়েছেন। সেক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন দু'জনকেই জাতীয় কবি করা হলে কোন সমস্যা নেই। উনি মাথা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে ঝুঁকে পড়লেন সূচীর প্রতি। গভীর মনোযোগে বুঝে নিতে চাইছেন কী আছে, কী নেই, আর কেন আছে, কেন নেই-এর প্রকৃত কারণ।

ময়ূখ চৌধুরীর এই অভ্যাস মজ্জাগত, আশৈবের। এক জীবনের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতায় শাণিত। তিনি কবিতাকেও বুঝে নিতে চান। পরিস্কার থাকতে চান কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, এই প্রশ্নে। এভাবে সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও প্রশ্ন করেন শিরদাঁড়া সোজা করে। ময়ুখ চৌধুরীর শিরদাঁড়া দেখা যায়, জীবনাচারে, কবিতায়, বুদ্ধিজীবীতায় এবং প্রতিদিনের রোজনামচায়। এটাই উনার সাধনা, এক জীবনের ব্রত।

'মানুষেরা পারে' কবিতায় কবি লিখেছেন : 'নদীর মতন নয়, মানুষেরা হাঁটে খুব কম।/এই সক্ষমতা দাস-সভ্যতার আগে/ মানুষেরা জমা করে রাখতে শিখেছে।/ অহংকারী পিরামিড মাথা তুলে দেখে একদিন/ মানুষেরা পায়ে পায়ে পার হয়ে যায় নীলনদ/ নীলের সীমানা/ সাঁতার জানে না বলে নদীরা সমুদ্রে ডুবে যায়,/ মানুষেরা পার হতে পারে।' 'হোমারের চোখ' কবিতায় বলেছেন, 'জটিল ঘুমের ঘোরে নদীর দু'তীর যদি/চোখের পাতার মতো কোনোদিন এক হয়ে যায়,/ মোহনায় যাবার আগেই/ মৃত্যু হবে তার।/এ সব দৃশ্যের কথা ভেবে/অগ্নিকাণ্ড বুকে নিয়ে সারা রাত জেগে থাকে ধ্রুপদী হেলেন।/চক্ষুষ্মান অন্ধদের এই দৃশ্য দেখাবেন বলে/পৃথিবীতে হোমার এলেন।'

নকল বুদ্ধিজীবীর ভীড়ে এই রাষ্ট্র কি চিনে নেবে না ময়ুখ চৌধুরীর মতো প্রকৃত বুদ্ধিজীবীকে। কবির জন্য এই রাষ্ট্রের এই সমাজের, এদেশের প্রতিষ্ঠান সমূহের কোন দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ কি নেই? পালন করবে না? বাংলা একাডেমি কি ময়ুখ চৌধুরীর মতো কবিকে সম্মান না জানিয়ে জসীমউদ্দীন, আবু হেনা মোস্তফা কামালের সারিতে উনার নামটাও রাখতে চায়?
 

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

3h ago