দোকান ভাড়া ৩ লাখ টাকা, সরকার পায় ২২ হাজার

ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটে
ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটের দোকান। ছবি: পলাশ খান/স্টার

সরকারি মালিকানাধীন একটি দোকান থেকে মাসে তিন লাখ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও কোষাগারে জমা পড়ছে কেবল ২২ হাজার টাকা।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) নয়টি মার্কেটে বরাদ্দ দেওয়া দোকানগুলোর ভাড়া নিয়ে বড় ধরনের অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক তদন্তে। উপরের ঘটনাটি সেই অনিয়মের একটি উদাহরণমাত্র।

গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত তদন্ত কমিটি এ ধরনের অনিয়মের ঘটনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যাচাই করছে।

কমিটি যেসব অনিয়মের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, তার মধ্যে আছে নিয়ম না মেনে দোকান বরাদ্দ দেওয়া, ঊর্ধ্বে চারবার পর্যন্ত একই দোকানের ইজারা বদল, জরুরি পরিষেবার অপব্যবহার, অবৈধ দখলদারি ও আর্থিক নথিতে গরমিল।

গত বছরের নভেম্বরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ১৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।

এনএসসি কর্মকর্তারা এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারবেন না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, এনএসসির কর্মকর্তা, স্টেডিয়াম প্রশাসন ও দোকান মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দোকান বরাদ্দ ও ভাড়া আদায় সংক্রান্ত অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এসব অপরাধ তদন্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের (দুদক) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

নয়টি মার্কেটই রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। সব মিলিয়ে এগুলোতে এক হাজার ৭৫টি দোকান রয়েছে।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

হাতবদল হয় দোকান, বাড়তে থাকে ভাড়া

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল ইজারাদারদের অনেকেই এনএসসিকে ন্যূনতম মাসিক ভাড়া দিলেও তারা অত্যন্ত চড়া দামে অন্যদের কাছে ওই দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছে। বারবার ইজারা হাতবদল হয়েছে। কখনো কখনো দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পক্ষের কাছেও ইজারা হস্তান্তর করা হয়েছে।

যার ফলে মূল পরিমাণের তুলনায় ভাড়া ১০ থেকে ১৫ গুণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

উদাহরণস্বরূপ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ৮১২ বর্গফুট আয়তনের দোকানটির মূল ইজারাদার শামসুর রহমান গং প্রতি মাসে সরকারকে মাত্র ২১ হাজার ৯৩৪ টাকা ভাড়া দিলেও তিনি যে চতুর্থ পক্ষের কাছে ইজারা দিয়েছেন, তার কাছ থেকে তিনি মাসে তিন লাখ টাকা ভাড়া আদায় করে থাকেন।

এর মানে হলো বাড়তি ১৩ গুণ ভাড়া থেকে এনএসসি এক পয়সাও উপার্জন করে না।

একইভাবে, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের ১৫৬ বর্গফুট আয়তনের দোকানটির ইজারাদার মো. জামাল হোসেন মাত্র চার হাজার ৩৫৭ টাকা ভাড়া দেন সরকারকে।

অপরদিকে, বর্তমানে যিনি ওই দোকানটি পরিচালনা করছেন, তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দেন।

এনএসসির নয়টি মার্কেটেই এ ধরনের অনিয়মের নজিরের অভাব নেই।

এই তালিকায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও ভলিবল স্টেডিয়াম সংলগ্ন সুপার মার্কেট, মিরপুরের শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের বহির্ভাগে অবস্থিত মার্কেট, কমলাপুরের বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম মার্কেট ও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাছে অবস্থিত সুইমিং পুল মার্কেট অন্তর্ভুক্ত।

বিষয়টি নিয়ে জানতে শামসুর রহমান ও মো. জামাল হোসেনের নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ধরেননি। খুদেবার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি।

বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ এক দশক আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সালে গঠিত এনএসসির দোকান বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ ২০১৬ সালে উত্তীর্ণ হলেও নতুন করে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।

ফলে ২০১৫ সালের পর থেকে দেওয়া কোনো বরাদ্দের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম-নীতি মানা হয়নি।

এনএসসির নীতি অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর ভাড়া পুনর্নির্ধারণের কথা বলা হলেও কমিটি উল্লেখযোগ্য হারে ভাড়া বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে ইজারাদারদের নিজেদের পকেট ভারী হলেও এনএসসির আদায় করা আয়ের পরিমাণ বাড়েনি।

এই কারণে আয়ের হিসাব নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

পে অর্ডার, আয়-ব্যয় সংক্রান্ত বিবৃতি ও মার্কেট-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্থিতির মধ্যে গরমিল চিহ্নিত করার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

পাশাপাশি, নতুন বা খালি জায়গা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে টেন্ডার প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক হলেও এই প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের ৩১টি দোকানের অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

অন্যান্য অনিয়ম

প্রতিবেদনে এনএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমবায় সমিতির বিষয়টিও উঠে এসেছে। চার বা তার চেয়েও বেশি অংশের দোকানের মালিকানা এই সমিতির হাতে, যা এনএসসির নীতির পরিপন্থি বলে জানা গেছে।

আর্থিক বিষয়গুলো ছাড়াও এই তদন্তে সরকারি অবকাঠামোর গুরুতর অপব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।

মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের সিঁড়িগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। গাড়ি ধোয়ার কাজে স্টেডিয়ামের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অননুমোদিত ব্যবহারকারীদের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, যা অবৈধ।

কমলাপুরে এনএসসির কর্মচারীদের ১৬-১৭টি পরিবার মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের তৃতীয় তলায় অবৈধভাবে বসবাস করছে।

পাশাপাশি, সেখানে দোকান মালিকদের সংগঠন অবৈধভাবে কার্যালয় পরিচালনা করছে, যার কোনো আনুষ্ঠানিক বরাদ্দ নেই। সংগঠনটি অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত।

'এখানে অনিয়মই যেন নিয়ম'

১৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও ভলিবল স্টেডিয়ামের ১৩টি দোকানে সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক।

দোকানদাররা সবাই জানান, তারা কেউই নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি এনএসসির কাছ থেকে দোকান ভাড়া নেননি।

পরিবর্তে, তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা এমনকি চতুর্থ পক্ষের কাছ থেকেও দোকান ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের মোবাইল স্পেস নামের দোকানের মালিক শফিকুল আলম জানান, তিনি ২০ বছর আগে দ্বিতীয় একটি পক্ষের কাছ থেকে দোকানটি ইজারা নিয়েছেন।

তিনি জানান, তারা মাসে ওই পক্ষকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দেন। তবে মূল ইজারাদার এনএসসিকে কত টাকা দেয়, তা তিনি জানেন না।

'এখানে কোনো নিয়ম নেই। অনিয়মই এখানকার নিয়ম', মন্তব্য করেন তিনি।

একই মার্কেটে নিলয় কর্পোরেশন নামের দোকানের মালিক রফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল জানান, তিনি তৃতীয় একটি পক্ষের কাছ থেকে ১৮ বছর আগে এই দোকান ভাড়া নেন। বর্তমানে ভাড়া বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি দাবি করেন, মূল ইজারাদার প্রতি মাসে এনএসসিকে দেয় মাত্র দুই হাজার ৬০০ টাকা।

মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের নাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক নজরুল ইসলামও একই ধরনের মন্তব্য করেন।

তবে এই কাজের পক্ষে অবস্থান ঢাকা স্টেডিয়াম দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এস এম আব্বাসের।

তিনি বলেন, 'ইজারা নেওয়ার পর যদি কেউ নিজে দোকান চালাতে না পারে, তাহলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তরে সমস্যা কোথায়? এখানে অপরাধটা কী?'

ছবি: পলাশ খান/স্টার

এখনো কোনো দোকানের বরাদ্দ বাতিল হয়নি

তদন্তের পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এসব অনিয়ম নিয়ে আরও অনুসন্ধান ও সমস্যা সমাধানের জন্য পাঁচটি কমিটি গঠন করেছে।

এনএসসির সচিব মো. আমিনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তারা প্রতিবেদনের ১৩ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন, যার মধ্যে আছে বরাদ্দ প্রক্রিয়ার অটোমেশন, নিয়মিত অডিট পরিচালনা ও প্রচলিত নীতিমালার নিরীক্ষা।

তবে তিনি জানান, এখনো কোনো দোকানের ইজারা বাতিল হয়নি।

'যদি সুপারিশগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আমাদের বিশ্বাস, এতে এনএসসির আয় আরও বাড়বে', ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

তিনি আরও জানান, আরও যাচাই-বাছাই শেষে মোট ক্ষতির পরিমাণ জানানো সম্ভব হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতে কেবল অনিয়মের অংশবিশেষ সামনে এসেছে।

'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও এনএসসি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়া চালু থেকেছে', বলেন তিনি।

এ বিষয়টিতে দুদকের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'যারা সামনে আছেন, শুধু তাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং যারা নেপথ্যে থেকে এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছেন এবং এসব অনিয়ম থেকে বছরের পর বছর ফায়দা লুটেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও মন্ত্রণালয়কে এখন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।'

বিষয়টি নিয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহেদির নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ধরেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠালেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Magura child rape case trial begins; four indicted

The court has set April 27 for the next date of hearing in the case

7m ago