রাজনৈতিক বিবেচনায় সৃষ্ট ব্যাংকগুলো জনগণের অর্থ লোপাটেই বেশি মনোযোগী: ফখরুল

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত

ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আজ শুক্রবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে শনির আছর পড়েছে বর্তমান আওয়ামী ফ্যাসিস্ট লুটেরা সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার শুরুর দিকেই। যার পরিণতিতে আজ সমগ্র অর্থনীতি ভয়াবহ নৈরাজ্যকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রতিটি প্রধান সূচকের (মূল্যস্ফীতি, নিম্নমুখী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নিম্নমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহ, চলতি হিসাবের ঘাটতি, রাজস্ব ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার দরপতন) অবস্থান এতটাই শোচনীয়, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট আগের তুলনায় অনেকটা কমেছে। বিশ্ব অর্থনীতি গতি হারালেও থমকে যায়নি। অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে সফল হচ্ছে।'

'কী ভয়ংকর ও বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কা কত দ্রুত ওভারকাম করতে শুরু করেছে। তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে ধার নেওয়া কিছু ঋণ ইতোমধ্যে শোধও করেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের আগস্টে নেমে হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের মাথায় ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে এনেছে শ্রীলঙ্কা। অথচ আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে তো পড়ছেই। যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে অস্বচ্ছ ও সমন্বয়হীনভাবে সমস্যাগুলোর সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পেয়েছেন "ডি" গ্রেড, আর শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়াত্ব ও ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি থেকে বের করে আনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পেয়েছেন "এ মাইনাস"। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবেই মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ, খাদ্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১২ শতাংশ (প্রথম আলো: ৯ অক্টোবর ২০২৩ )। যদিও বিবিএস হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার পার্থক্য প্রায় দ্বিগুণ।'

বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দাম আরও বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এখন খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুণতে হচ্ছে ১১৭-১১৮ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ভবিষ্যতের জন্য ডলার বুকিং দিয়ে রাখলে এক বছর পর প্রতি ডলারে ১২৩ টাকা ৩৫ পয়সা পরিশোধ করতে হবে (প্রথম আলো: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পতনও ঠেকানো যাচ্ছে না। রিজার্ভ পতনে বিপর্যয়ের মাস সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আর আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে নিট রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলার (বণিক বার্তা: ৭ অক্টোবর ২০২৩)।'

'রেমিট্যান্সের বিপর্যয় আরও গভীর হয়েছে। টানা তিন মাস ধরে এ আয় কমেছে। ৪১ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন ১৩৪ কোটি ডলার হয়েছে (প্রথম আলো: ৯ অক্টোবর ২০২৩)। গত তিন বছরের মধ্যে সেপ্টেম্বরে একক মাসে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে (বণিক বার্তা: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। প্রতি মাসে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে, তাতে বড় ধরনের সংকটের দিকে এগোচ্ছে দেশের অর্থনীতি।'

ডলারের অভাবে ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকরা এলসি খুলতে পারছে না উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'অবৈধ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, "রিজার্ভ নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই।" (সমকাল: ৮ অক্টোবর ২০২৩)। একদিকে দেশের সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারে না, হতদরিদ্র মানুষ পেট ভরে দুবেলা খেতে পারে না, অন্যদিকে আওয়ামী স্বৈরশাসকেরা উন্নয়নের গালগল্প করে দেশটিকে ঋণের জালে জর্জরিত করে দেউলিয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে। উন্নয়নের নামে আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, আর ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিণতিতে দেশ এখন প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা ঋণের চাকায় পিষ্ট। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, ভ্রান্তনীতি গ্রহণ, নীতির সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, সর্বোপরি লাগামহীন দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ সংকট থেকে বের হতে পারছে না। সম্প্রতি টিআইবি প্রকাশ করেছে, গত ১১ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার ই-টেন্ডার প্রক্রিয়ায় "সরকারি ক্রয়" করা হয়েছে সিঙ্গেল বিড ভিত্তিতে, কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়া (ডেইলি স্টার: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।'

দেশের ব্যাংকিং সেক্টর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে নিমজ্জিত বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই আমাদের অর্থনীতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। মূলত সরকারের পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বগ্রাসী লুটপাট আমাদের অর্থনীতির জীবনী শক্তিকে ক্রমেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার সর্বশেষ সংযোজন—কেবলমাত্র দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন নামে একটি বিশেষ গ্রুপ তথা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের হাতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে জনতা ব্যাংক ২২ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে।'

'সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকে। একটি শিল্প গ্রুপ নামে-বেনামে অস্তিত্বহীন ভুয়া কোম্পানির নামে কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ গ্রুপটি সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার যোগ্য। এই গ্রুপটি ন্যূনতম এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। অথচ উচ্চ আদালত থেকে এ অর্থ লোপাটের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। "বাংলাদেশের যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুটপাট এখন সবচেয়ে সহজ" বলে মন্তব্য করেছেন একজন অর্থনীতিবিদ। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে যারা বিদেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়েছে, একজন অর্থনীতিবিদ তাদেরকে "জাতীয় দুশমন" বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তারা ব্যাংকগুলোর "ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি" হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজারো কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী।'

মির্জা ফখরুল বলেন, 'সাধারণত কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলে বিদেশি ব্যাংকগুলো সেখানে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনো বিদেশি ব্যাংক কি বাংলাদেশে এসেছে? উল্টো যে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। একই ধরনের প্রোডাক্ট ও সেবা নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে দেশের ৫২টি ব্যাংক। পরিসংখ্যান বলছে ৩০০ থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি (৬১টি)। অর্থনীতিকে তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সৃষ্ট এই ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং নয়, বরং জনগণের অর্থ লোপাটেই বেশি মনোযোগী।'

'বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসির অনুপাত ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাউন্ডনেসে ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম, যা সাউথ এশিয়ান অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। অপরদিকে গ্লোবাল ইকোনমির গবেষণা মতে, বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ১৩৬ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম, যা ২০০৯ সালের তুলনায় ২২ ধাপ পিছিয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পাঁচে। সর্বশেষ বিএনপি সরকারের সময় যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়তে।'

বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সিগুলো কর্তৃক বাংলাদেশের ঋণমান হ্রাস বিষয়ে তিনি বলেন, 'বিগ থ্রি হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে বা নেতিবাচক সংকেত দিয়েছে, তাতে অর্থনীতি "রেড ফ্ল্যাগস" এ উঠে এসেছে। গত মে মাসে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি "মুডিস" বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বিএ৩ থেকে নামিয়ে বিএ১ এ পুনর্নির্ধারণ করেছে। যেখানে প্রতিটি দেশ ক্রমান্বয়ে ভালো রেটিং পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেখানে গত এক যুগ পর এই মান কমানো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।'

'গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের "রেটিং আউটলুক" হ্রাস করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তারা বাংলাদেশের জন্য 'নেতিবাচক' ঋণমান নির্ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে দেশের সার্বভৌম ঋণমান দীর্ঘমেয়াদে "বিবি মাইনাস" ও স্বল্পমেয়াদে "বি" নিশ্চিত করেছে। সর্বশেষ ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে "নেতিবাচক" ঘোষণা করেছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিদেশি ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছে না। দেশের এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, অবৈধ সরকারের উন্নয়নের শ্লোগের নিচে চাপা পড়েছিল, যা এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ।'

ব্যাংকিং খাত নজিরবিহীন তারল্য সংকটে আছে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'বেশ কিছুকাল থেকেই তারল্য সংকটে পড়ে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে তিন হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও তা দুই লাখ তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল। বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক নিয়মিত সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়ে জরিমানায় পড়েছে। এ সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে। কিন্তু তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক আমানতকারির নিজস্ব আমানতের এমনকি এক লাখ টাকার চেকও অনার করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।'

'অপরদিকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে লোন দেওয়া সংকুচিত হয়ে পড়েছে (ডেইলি স্টার: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। বিনিয়োগ ও ব্যবসার ওপর যার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত জুন শেষে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫-তে। মার্চে এ সংখ্যা ছিল ১১। মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি দ্রুত বেড়েই চলেছে। আর আমানতকারীদের আমানতের ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে (প্রথম আলো: ৯ অক্টোবর২০২৩)।'

এলসি খোলার হার কমছে, আর মূল্যস্ফীতি বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ছয় দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি এখন নজিরবিহীন মন্থরগতিতে চলছে। কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ কমছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এ এক মহা চ্যালেঞ্জ। তার ওপর রয়েছে স্বার্থান্বেষীদের সিন্ডিকেট। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। অনেকের সঞ্চয়ও শেষ। নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস তো আছেই।'

'বেপরোয়া লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলো ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। মূলধন ঘাটতি পূরণে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জনগণের অর্থ ঢালছে সরকার। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। কিন্তু এর পরও ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। এদিকে লুটপাটের শিকার বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করতে সরকারি ফান্ড ২৫ শতাংশের স্থলে ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার নির্দেশ দিয়ে সরকার লুটপাটের আরও সুযোগ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সব ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে হয়, তা-ও ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করেছে সরকার। এতে আমানতকারিদের অর্থের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পেল। কিন্তু ভোটারবিহীন জনবিচ্ছিন্ন সরকারের তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ তাদের তো জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নাই।'

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'খেলাপি ঋণ গত ১০ বছরে তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, তা ২০২৩ সালের মার্চে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের আট দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সহনীয় ধরা হয়। এর বেশি হলেই তা ঝুঁকি। বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ ঝুঁকির চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। প্রলেপ দিয়ে নিয়মিত রাখা হয়েছে।'

'এদিকে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ, অবলোপন করা ঋণ, অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা বিপুল অঙ্কের ঋণ, বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করাসহ আরও অনেক ঋণ রয়েছে, যেগুলো খেলাপির যোগ্য, কিন্তু খেলাপি করা হচ্ছে না। এসব ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে খেলাপি ঋণ যা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। এমনকি আইন সংশোধন করে সরকার ঘনিষ্ঠ অলিগার্কদের একাধিকবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সঠিক পর্যালোচনা ও জাস্টিফিকেশন না থাকা সত্ত্বেও মনগড়াভাবে লোন রাইট অফ করা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাঘেষা লোকদের রক্ষা করার জন্য।'

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'আর্থিক খাতসহ দেশে আইনের শাসন ও সার্বিক শৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জবাবদিহিতা। যেহেতু বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাদের হাতে আমাদের এই দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থা—কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। তাই আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহ্বান, আসুন বাংলাদেশে একটি সত্যিকার জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং দুঃসহ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করি। তাহলেই ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যাংকিং সেক্টর তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

12h ago