ডিসি সম্মেলন শুরু আজ

এসপি-ওসিদের এসিআর লিখতে চান ডিসি-ইউএনওরা

পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চান জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। ডিসি সম্মেলন উপলক্ষে অন্তত দুটি জেলার ডিসি এ সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছেন।

বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডিসি ও ইউএনওরা আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির প্রধান হলেও এসপি ও ওসিদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। ১৯৭৭ সালের আগ পর্যন্ত এ ক্ষমতা ডিসিদের হাতে ছিল।

ডিসিদের কাছ থেকে আসা প্রায় এক হাজার ২০০টিরও বেশি প্রস্তাবের মধ্যে ৩৫৪টি নিয়ে আজ রোববার তিনদিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনে শুরু হচ্ছে।

সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস। এরপর সম্মেলনের বাকি কার্যঅধিবেশগুলো রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে।

এবারের ডিসি সম্মেলনের বাজেট ধরা হয়েছে পৌনে দুই কোটি টাকা।

এসপি-ওসিদের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার যুক্তি হিসেবে সাতক্ষীরার ডিসি তার প্রস্তাবে বলেছেন, 'জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির প্রধান হলেও প্রকৃতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কোনো দাপ্তরিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।'

সাতক্ষীরার ডিসি মনে করেন, 'এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।'

গাইবান্ধার ডিসি তার প্রস্তাবে বলেছেন, 'জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য তিনি দায়িত্বশীল ও তাকে জবাবদিহি করতে হয়। ফলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক  পুলিশের কার্যক্রমের মূল্যায়ন প্রয়োজন।'

তিনি আরও বলেছেন, 'জেলা পুলিশের কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে এবং জনকল্যাণমূলক পুলিশ বাহিনী বাস্তবায়নে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।'

১৯৭৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এসপিদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা ডিসিদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে ডিসিরা এ ক্ষমতা চাইলেও কোনো সরকারই তা বাস্তবায়ন করেনি।

প্রায় সাড়ে চার দশক আগে বাতিল হওয়া এ ক্ষমতা ডিসিদের ফিরে পাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক ডিসি ও সচিব এ কে এম আব্দুল আওয়াল মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।'

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সম্মেলনের সংশ্লিষ্ট অধিবেশনে চূড়ান্তভাবে এসব প্রস্তাব রাখা হবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বৈঠক সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্মেলনের লিখিত প্রস্তাবে এগুলো না রাখা হলে মৌখিকভাবে ডিসিদের এসব প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ আছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ‍মুক্ত আলোচনায় এ বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকটি সূত্র জানায়, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা মনে করেন, মাঠ প্রশাসনে এসপি ও ওসিদের ওপর ডিসিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এটাই উপযুক্ত সময়। কারণ, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা ডিসি ও এসপিদের নিজেদের হাতে রাখতে ক্ষমতা বিভাজনের নীতিতে চলেন। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ।

সাবেক আরেকজন ডিসির মনে করেন, 'আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া তিনটি নির্বাচন নিয়ে প্রায় সবাই ডিসিদের দোষ দেন। কিন্তু পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশে ভোটবাক্স ভরে দিয়েছে, সেখানে ডিসিরা তেমন কিছু করতে পারেনি। আমার মতে এসপি ও ওসিদের নিয়ন্ত্রণ যদি ডিসি ও ইউএনওদের হাতে থাকে, তাহলে নির্বাচনী অনিয়মের জন্য ডিসিদের দায়ী করার যৌক্তিক হবে।'

এর বাইরে সাবেক ও বর্তমান অন্তত চারজন ডিসির সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়েছে। তাদের সবার মত, এসপি ও ওসিদের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই ডিসিদের হাতে থাকা উচিত। এতে করে জেলা ও উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হবে, কমবে দুর্নীতি।

সাবেক ডিসি ও বর্তমানে যুগ্মসচিব এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই হয়েছে মেট্রোপলিটন এলাকায়। কারণ, এসব এলাকায় পুলিশের গুলির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগে না। পুলিশ কমিশনার নিজেই অনুমতি দেন। যেহেতু এই সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সরকার, তারা এই বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে পারে।'

আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'যার হাতে অস্ত্র, তার হাতে কলম থাকবে না— এটাই স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম হওয়ার কথা। বর্তমানে এসপি ও ওসিরা ডিসি ও ইউএনওদের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়তে হয়।'

এসি (ল্যান্ড) হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এক তরুণ কর্মকর্তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, 'জরুরি প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে গেলে ওসিরা ঠিক সময়ে ফোর্স দেন না। ফলে যে উদ্দেশ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার করা হবে তা সফল হয় না।'

ডিসি সম্মেলন নিয়ে শনিবার বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ জানিয়েছেন, সম্মেলনে এবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে মোট কার্যঅধিবেশন হবে ৩০টি এবং চারটি হবে বিশেষ অধিবেশন। বিশেষ অধিবেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার মুক্ত আলোচনা, প্রধান বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক।

তিনি বলেন, এবারের প্রধান আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। এ বিষয়ক প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছে মোবাইল কোর্ট আইনের বিধিমালা করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তব্যরত অবস্থায় বডি ক্যামেরা রাখা, মারণাস্ত্র ও ছররা গুলি ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব আছে।

তবে অন্যান্য বছরের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ডিসিদের এবার কোনো সাক্ষাতের ব্যবস্থা থাকছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, 'সময়সূচি মেলানো যায়নি।'

আব্দুর রশিদ জানান, এবারের সম্মেলনে ডিসিদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে জনসেবা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি, জনদুর্ভোগ কমানো, রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ, পর্যটন বিকাশ, আইন-কানুন বা বিধিমালা সংশোধন, জনস্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হয়েছে। বেশি সংখ্যক প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সংশ্লিষ্ট। এই খাতে প্রস্তাব রয়েছে ২৮টি।

এ ছাড়া, আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবস্থাপনা; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম জোরদারকরণ; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম; স্থানীয় পর্যায়ে কর্ম সৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন; সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ও ই-গভর্ন্যান্স; শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ; স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ; পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ রোধ; ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও সমন্বয়ের বিষয়গুলো আলোচনায় প্রাধান্য পাবে।

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

1h ago