২০২৪

ব্যাংকিং খাতের ‘প্রকৃত ক্ষত’ বেরিয়ে আসার বছর

অলঙ্করণ: স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

গত অক্টোবরে সামাজিক মাধ্যমে এক ভিডিওতে দেখা যায়—নগদ টাকা তুলতে না পারায় হতাশ গ্রাহকদের গালি শুনে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আগারগাঁও শাখার ব্যবস্থাপক কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে নগদ টাকার তীব্র সংকট বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। টাকা না পেয়ে অক্টোবর-নভেম্বরে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় বিক্ষোভ, ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের দ্বারা শাখা ব্যবস্থাপকদের অবরুদ্ধ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও আস্থার সংকটে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুর অবস্থার সাক্ষ্য দেয় সামাজিক মাধ্যমের ওই ভিডিওটি। এই অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা শরিয়াহভিত্তিক বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এই কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়ম আর জালিয়াতি প্রকাশ্যে এলে পুরো ব্যাংকিং খাতই আস্থার সংকটে পড়ে।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা অস্পষ্ট ছিল। গত ৫ আগস্ট তার পতনের পর ব্যাংক খাতের আসল চিত্র বের হতে শুরু করে।

২০২৪ সালে ব্যাংকিং খাত সংকটে জর্জরিত হয়। এ সময় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য ঘাটতি, মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, অপরিকল্পিত একীভূতকরণ ও খেলাপি রেকর্ড বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের জন্য চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আর্থিক খাতের সংস্কারকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে দিয়েছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয়েই কিছু সংস্কার শুরু করেছিল।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার পদ্ধতিগত অনিয়ম মোকাবিলা ও সংস্কার বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ নেয় বছরের শেষ দিকে এসে। ইতোমধ্যে থেমেছে লুটপাট। তবে অনিশ্চয়তা আছে ব্যাংক খাত সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে।

হতাশাজনক সূচনা

বছরটি শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরে সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি।

কয়েকবার নীতিসুদ হার বাড়ানোসহ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ নেই।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কয়েক মাস ধরে অস্থির থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। দুই বছরের ব্যবধানে দেশে ডলারের মজুত অর্ধেকে নেমে আসে। টাকার দাম প্রায় ২৮ শতাংশ কমেছে।

এর ফলে ব্যাংকিং খাত আরও চাপে পড়ে। বিশেষ করে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের অভাব ও তারল্য ঘাটতি চলছে। তবে বছরের শেষে এসে রেমিট্যান্স বেড়েছে যা আশার আলো দেখাচ্ছে।

বছরজুড়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা

কয়েকটি ব্যাংক ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বছরজুড়ে তারল্য সহায়তা দিয়েছে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও। কোনো রকম সিকিউরিটিজ ছাড়া তারল্য সহায়তা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা ছিলেন এই উদ্যোগের ঘোর সমালোচক।

সমালোচকদের ভাষ্য, এই ধরনের উদ্যোগ ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করছে। এই খাতের কাঠামোগত ত্রুটিগুলো সমাধান করা দরকার।

২০২৩ সাল শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ ইসলামি ব্যাংকসহ সাত ব্যাংককে ২২ হাজার কোটি টাকা দেয়। এরপর জানুয়ারিতে সার-বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে সরকার যে স্পেশাল পারপাস ট্রেজারি বন্ড ছেড়েছিল, এর বিপরীতে ছয় ব্যাংককে ১২ হাজার কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদরা কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করেছেন। তাদের যুক্তি, 'টাকা ছাপানো'য় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সরকার পতনের পরও গত নভেম্বরে সংকটে পড়া ছয় ব্যাংককে সহায়তা হিসেবে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

ত্রুটিপূর্ণ একীভূতকরণের উদ্যোগ

বিগত সরকারের নির্দেশনা অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পাঁচ দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেন। এর ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা নগদ টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়লে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয়।

সমস্যাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মার্চে একীভূত করার সিদ্ধান্ত ছিল প্রথম উদ্যোগ।

পরে আরও কয়েকটি ব্যাংকের নাম প্রকাশ্যে এলে শেষ পর্যন্ত ব্যাপক হারে টাকা তোলার কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ে।

তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়।

বাজারভিত্তিক সুদের প্রত্যাবর্তন

সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে একটি সীমা ছিল দীর্ঘ চার বছর, যা গত মে মাসে বাজারে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য তা করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালে সরকারি নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একক অঙ্কের ঋণ হার চালু করে। ব্যাংকগুলোকে ঋণের ওপর সর্বোচ্চ নয় শতাংশ সুদ নেওয়ার অনুমতি দেয়।

অর্থনীতিবিদরা ঋণের ওপর একক অঙ্কের সুদ ব্যবস্থার সমালোচনা করে বলেন, এটি অসৎ ঋণগ্রহীতাদের জন্য কম খরচে টাকা নিয়ে পাচার করার সুযোগ তৈরি করেছে। ঋণের ওপর একক অঙ্কের সুদহারও উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে।

২০২৩ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের ওপর নয় শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে নেয়। সুদের হার নির্ধারণে ছয় মাসের মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) ফর্মুলা চালু করে।

গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ফর্মুলা বাতিল করে ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করে দেয়।

একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনাবেচায় 'ক্রলিং পেগ' ব্যবস্থা চালু করে। ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১১৭ টাকায় ডলার কেনাবেচার অনুমতি দেয়।

রেকর্ড উচ্চতায় খেলাপি ঋণ

গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

এর মধ্যে মাত্র তিন মাসে খেলাপি হয়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৪ দশমিক আট শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দুই মাসেরও কম সময়ে এ খাতের প্রকৃত চিত্র সামনে আসে। তাদের মতে, পুনঃতফসিল ও অবলোপিত ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

গণঅভ্যুত্থানে ব্যাংকিং খাতের সংকট

গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় ব্যাংকিং সেবা সীমিত হয়ে পড়ে।

আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় এক সপ্তাহের জন্য সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।

এর ফলে ডিজিটাল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও রেমিট্যান্স আয় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মাসজুড়ে নগদ টাকা তোলার ওপর বিধিনিষেধ ছিল।

এ ছাড়াও, নিরাপত্তার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল অধিকাংশ এটিএম বুথ।

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ব্যাংকিং খাত

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আব্দুর রউফ তালুকদার আড়ালে চলে যান এবং পদত্যাগ করেন। পরে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন গভর্নর ১১ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেন। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের আধিপত্য ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কার অব্যাহত ও দ্রুত করতে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প শক্তিশালীকরণ ও আইনি কাঠামো নিয়ে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়।

বিশেষজ্ঞ দলটি গত ডিসেম্বরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র জমা দেয়। সেখানে 'ডিপ ইনটু অ্যা ব্ল্যাক হোল' নামে একটি অধ্যায় ছিল। যেখানে ব্যাংক খাতের অনিয়মের গভীরতা উল্লেখ করা হয়।

সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক অডিট, পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও অন্যান্য আর্থিক জালিয়াতি তদন্তে সরকারি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

যদিও এই সংস্কার উদ্যোগগুলো জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তদারকি জোরদার গুরুত্বপূর্ণ দিক, তবে অর্থনীতি চাঙ্গা করার পথ এখনো দীর্ঘ ও অনিশ্চিত থেকে গেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Pope Francis dies at 88

His death came just a day after he delighted the crowds of worshippers at the Vatican on Easter Sunday with an appearance on the balcony at Saint Peter's Basilica.

1h ago