মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার শ্রীপুর বাহিনী
(১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাংলাদেশে একাধিক আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত ও সাব সেক্টরের অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি আঞ্চলিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে অসীম বীরত্ব দেখিয়েছেন। বিজয়ের মাসে আমরা তুলে ধরছি ১০টি বাহিনীর কথা। তৃতীয় পর্বে আজ থাকছে শ্রীপুর বাহিনীর অনন্য বীরত্বগাঁথা।)
মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পাকিস্তানি সেনা ও শত্রুপক্ষের কাছে সাক্ষাৎ ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। আকবর হোসেন মিয়া নামের সেই চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মাগুরার শ্রীপুরে গড়ে উঠেছিল একটি দুর্ধর্ষ আঞ্চলিক বাহিনী। কাগজে কলমে আকবর হোসেনের বাহিনীটি 'শ্রীপুর বাহিনী' হিসেবে পরিচিতি পেলেও লোকমুখে তা আকবর বাহিনী হিসেবেই পরিচিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মাত্র ছয়টি রাইফেল নিয়ে শুরু করা শ্রীপুর বাহিনীতে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আট শতাধিক।
মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর কার্যক্রম ও বীরত্বগাঁথা নিয়ে আকবর হোসেন রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী' বই থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আকবর হোসেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মাত্র ৩ বছর পরেই ১৯৫৪ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৫ সালে শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সংগঠিত হওয়া
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিজের অনুসারী ও স্থানীয় ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করতে শুরু করেন আকবর হোসেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার পর জাতীয় পরিষদের সদস্য সোহরাব হোসেন ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও সৈয়দ আতর আলীর নেতৃত্বে মাগুরায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আকবর হোসেন।
সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাগুরার নোমানী ময়দানের পার্শ্ববর্তী আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আসা তরুণদের বেশিরভাগই ছিলেন শ্রীপুর কলেজের শিক্ষার্থী।
২৮ মার্চ আকবর হোসেনের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা মোল্লা নবুয়ত আলী, খন্দকার নাজায়েত আলী, খন্দকার সুজায়েত আলী।
এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তানী বাহিনীর মাগুরায় আসার আগমুহূর্তে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মাগুরা আনসার ক্যাম্প থেকে ৬টি রাইফেল, ওয়্যারলেস ও বেশ কিছু গোলাবারুদ নিয়ে শ্রীপুরে চলে আসেন। এসময়ে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে শ্রীপুর বাহিনী।
শুরু থেকেই শ্রীপুর বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো বজায় ছিল। শ্রীপুর বাহিনীর উপঅধিনায়ক ছিলেন মোল্লা নবুয়ত আলী এবং সহঅধিনায়ক ছিল খন্দকার নাজায়েত আলী। ১৯৭৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাজায়েত আলী এবং ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নবুয়ত আলী মারা যান।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুই ধরনের শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ছাড়াও স্থানীয় দুর্ধর্ষ ডাকাত, দস্যু ও বিহারীরা বাহিনীর অন্যতম প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে মাগুরা ও ফরিদপুর অঞ্চলে ডাকাত দলের তৎপরতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার সুযোগে ডাকাতেরা লুটপাট, হত্যা, এমনকি ধর্ষণের মতো কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। আকবর হোসেন তার গ্রন্থে লিখেছেন, 'মুক্তির সংগ্রাম লুটের সংগ্রামে পরিণত হলো।'
এসময় স্থানীয় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বেশ কয়েকজন ডাকাতকে হত্যা করেন শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় ডাকাতেরাও ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে পাকিস্তানি বাহিনীও তখন ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর সম্মিলিতভাবে সর্বপ্রথম অপারেশন ছিল ৫ জুন রাজবাড়ীর রামদিয়ায়।
একের পর এক অপারেশন ও দুর্ধর্ষ ডাকাত নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে আশেপাশের অঞ্চলগুলোতেও শ্রীপুর বাহিনীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা, ইপিআর, আনসার সদস্যসহ বহু ছাত্র, যুবক, তরুণ শ্রীপুর বাহিনীতে যোগ দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয় টুপিপাড়া গ্রামে খোলা হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।
থানার নামে বাহিনীর নামকরণ করা হলেও শ্রীপুর বাহিনীর অবস্থান কেবল শ্রীপুর বা মাগুরার থানাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহের শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডু, রাজবাড়ীর পাংশা, বালিয়াকান্দি, ফরিদপুরের মধুখালী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল শ্রীপুর বাহিনীর অবস্থান।
গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন
শ্রীপুর বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিল ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানা দখল। ৯ আগস্ট দিবাগত রাতে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল শৈলকুপা থানায় আক্রমণ চালায়। প্রথম পর্যায়ের আক্রমণে পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে ফিরতি আক্রমণ চালান। এসময় থানায় থাকা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানসহ পুলিশ রাজাকা সহ অন্তত ৩০ জন আত্মসমর্পণ করে।
অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাত দেড়টার দিকে আমরা থানায় আক্রমণ চালাই। প্রথমেই আমাদের গুলিতে এক বিহারী সাব রেজিস্ট্রার মারা যায়। কিন্তু থানার চারদিকে বাঙ্কার থাকায় আমরা পিছু হটে দামুকদিয়া স্কুলে অবস্থান নিই। সেদিন ভোরের আগে পুনরায় আমরা থানায় আক্রমণ করতে গেলে ওরা আত্মসমর্পণ করে।'
পরবর্তীতে থানা থেকে ৫৭টি রাইফেল ও ৪ হাজার গুলি উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
শৈলকূপা থানা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩০টিরও বেশি যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসীম বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। এই যুদ্ধগুলোর মধ্যে ছিল— আলফাপুর, নাকোল, কাজলীর যুদ্ধ, চার বার শ্রীপুর থানা অপারেশন, বালিয়াকান্দি থানা আক্রমণ, ইছাখাদা ও বিনোদপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, মাগুরা আনসার ক্যাম্প আক্রমণ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও সফল যুদ্ধগুলোর একটি ছিল ঝিনাইদহের শৈলকূপার আলফাপুরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ৫৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
শৈলকুপা থানা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনারা শ্রীপুর থানার দিকে অগ্রসর হলে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মোকাবিলার জন্য সরাইনগর ও আলফাপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় শ্রীকোল দিয়ে অগ্রসর হতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা নদীর দু'ধার দিয়ে অগ্রসর হলে মীনগ্রাম ও সরাইনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা কুমার নদ দিয়ে আলফাপুর খালে ঢুকতেই মুক্তিযোদ্ধাদের দুদিক থেকে আক্রমণের মুখে পড়ে।
যুদ্ধে অংশ নেয়া শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান লাল বলেন, 'খালের একপাড়ে ছিলাম আমরা, অন্য পাশে কামরুজ্জামান খুসুর নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ। পাকিস্তানিরা খালে ঢুকতেই খুসু গ্রুপ প্রথমেই ব্রাশফায়ার শুরু করে। এরপর এপাশ থেকেও আমরা ফায়ার করি। ওরা ভাবতেও পারেনি এমন ভয়াবহ আক্রমণে পড়বে।'
মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসে পুনরায় শ্রীপুর থানা দখল করে আকরাম হোসেন নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে থানার ওসি হিসেবে নিযুক্ত করেন শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত।
মুক্তিযুদ্ধের ১০ অক্টোবর পাঁচশর বেশি পাকিস্তানি সেনা শ্রীপুর বাহিনীর টুপিপাড়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। আগেই খবর পেয়ে ক্যাম্প ছেড়ে নদীর ওপাড়ে চলে যান মুক্তিযোদ্ধারা। এদিন পাকিস্তানি সেনারা নদী পার হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কাজলি ঘাটে নিহত হয় আরও ৩ পাকিস্তানি সেনা।
১৩ অক্টোবর চতুড়িয়া গ্রামে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
একইদিন দুপুরে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণের লক্ষ্যে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে মাশালিয়া মসজিদের কাছে অবস্থান নেয়। একটি দলকে কভারিং ফায়ারের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের পিছিয়ে আনার দায়িত্ব দেয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পর লাঙ্গলবাঁধ যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশ পজিশনে ঢুকলে ব্রাশফায়ার শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় সম্মুখে থাকা পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ফের গুলির মুখে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে এসময় ৬ অফিসারসহ ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় নাকোল বাজারে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে এক কর্নেলসহ ৮ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা মো. দেলোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপারেশনের সন্ধ্যায় আমরা বাজারের পাশের ক্যানেলের দু'পাশে পজিশন নিয়ে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতি। আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টার দিকে লাঙ্গলবাঁধের দিক থেকে পাকিস্তানিদের একটি বহর এগিয়ে আসতেই আমরা আক্রমণ চালাই। প্রথম গাড়িটি পেরোতে পারলেও দ্বিতীয় গাড়িটি পেরোতে পারেনি। ওই জীপে থাকা পাকিস্তানি কর্নেলসহ সবাই মারা যায়। তখন শেষের মিলিটারি ভ্যানে থাকা পাকিস্তানি সেনারা আমাদের উপর গুলি চালায়। তবে প্রায় দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর একপর্যায়ে ওরা পালিয়ে যায়।'
মুক্তিযুদ্ধের অক্টোবর মাসে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে শ্রীপুর বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক বাহিনী ও আকবর হোসেনকে বাহিনী প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি সনদ দেন ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর।
Comments