মুক্তিযুদ্ধ

২০ নভেম্বর: যেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিন

রৌমারী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের আজকের দিনে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছবি: ব্যাটম্যান আর্কাইভ

১৯৭১ সালের ঈদের দিন ছিল আজকের এই দিনে তথা ২০ নভেম্বর। সেই ঈদ ছিল ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ মানেই উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা আর উৎসব হলেও মুক্তিযুদ্ধে ঈদ ছিল অন্যরকম। ঈদটি ছিল কেবলই মাতৃভূমির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার।

একাত্তরের ঈদের দিন কেমন ছিল তা উঠে এসেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক মাহবুব আলমের লেখা 'গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে'গ্রন্থে।

তিনি লিখেছেন, 'ছুটি নেই, আরাম নেই, বিশ্রাম নেই। বড় একঘেয়ে আর বিরক্তিকর জীবন সবার। এর মধ্যে ঈদের উৎসব একটা খুশির আবহ নিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্ত হয় ঈদের আগের দিন সবগুলো দল ২ ভাগে ভাগ হবে এবং সমবেত হবে ২ জায়গায়। নালাগঞ্জ আর গুয়াবাড়িতে। ছেলেরা তাদের নিজেদের মতো করেই ঈদ উৎসব পালন করবে। তবে নামাজ পড়বে একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে। গুয়াবাড়িতে সমবেত ছেলেরা ভারতীয় সীমান্তে উঁচু গড়ের পাদদেশে গিয়ে জামাত পড়বে।'

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের নামাজের বর্ণনায় মাহবুব আলম লিখেছিলেন অপরুপ সম্প্রীতির চিত্রও।

`নালাগঞ্জে জামাত হবে আমগাছ তলায় পুকুরের পাড়ে। মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামাজ পড়বে। হিন্দু ছেলেরা তাদের মুসলমান ভাইদের নামাজের সময় পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠে।'

মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম তার 'একাত্তরের ঈদের এই দিনে' প্রবন্ধে লিখেছেন, `আমাদের কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পাননি। তাছাড়া ঈদের দিনে গোসল করা, নতুন জামা-কাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।'

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিনটি ছিল মাতৃভূমির জন্য নিজেকে উৎসর্গের। অন্য দিনগুলোর মতো এই দিনেও মুক্তিযোদ্ধারা সদা তৎপর ছিলেন মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষায়।

একাত্তরের এই দিনটিতে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়ে জাতির ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন শহীদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম।

৬ নম্বর সেক্টরে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের পর বদলির আদেশ এসেছিল আশফাকুস সামাদ ও তার দলের। আশফাকুসের সঙ্গে ছিলেন লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ। ২ জনই অক্টোবর মাসে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে কমিশন পেয়েছিলেন। আশফাকুস ও আবদুল্লাহর বদলির আদেশ এলেও এরই মধ্যে তারা ২ জন মিলে রায়গঞ্জ আক্রমণের পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। লক্ষ্য ছিল, রায়গঞ্জ মুক্ত করে ফিরে যাবেন হেড কোয়ার্টারে।

হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের জন্য তারা বেছে নিয়েছিলেন ঈদের চাঁদ রাতকে। চাঁদ রাত ৯টার দিকে লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ২টি মুক্তিযোদ্ধা দল এগিয়ে গেলেন হানাদারদের ঘাঁটির দিকে।

২টি দলেই ছিলেন ১৫ জন করে মুক্তিযোদ্ধা। ঠিক করা হয়েছিল তারা হানাদারদের অবস্থানের ৫০০ গজের মধ্যে এসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবেন। কিন্তু সেই সুযোগ মিলল না। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তারা যখন এফইউপিতে পৌঁছালেন তখনই হানাদাররা তাদের অবস্থান নির্ণয় করে ফেলল। হানাদাররা নদীর উভয় পাশে অবস্থান নিয়ে ৬টি মেশিনগান ও আর্টিলারির আওতায় নিয়ে এল আশফাকুস সামাদদের দলকে।

আশফাকুস সামাদ বুঝলেন তারা ঘেরাও হয়ে গেছেন। সুতরাং অসম লড়াই ছাড়া উপায় নেই। তখন তিনি সহযোদ্ধাদের ইশারায় শুয়ে পড়তে বলেন। ওয়্যারলেস সেট চালু করে লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহর উদ্দেশে হ্যালো বলতেই শুরু হলো হানাদারদের বৃষ্টির মতো আর্টিলারি ফায়ার, মর্টার আক্রমণ ও মেশিনগানের গুলি। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন মুক্তিযোদ্ধারা।

তখন লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, 'কেউ এক ইঞ্চিও পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে সবাই বাঁচব।' তার কথায় যেন হারানো মনোবল ফিরে পেলেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

শহীদ আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে তখন ভোর ঘনিয়ে আসছে। ঈদের দিনের ভোর। হানাদারদের আক্রমণ বেড়ে গেছে ৪ গুণ।। আশফাকুস সামাদ দেখলেন, সামনে মহাবিপদ। সিদ্ধান্ত নেন, যা করার তিনিই করবেন। নয়তো পুরো দলের ওপরে বিপর্যয় নেমে আসবে।

 হানাদারদের বিভ্রান্ত করার জন্য পজিশন পাল্টে ২০০ গজ পিছনে সরে একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে মেশিনগান পোস্ট স্থাপন করেন আশফাকুস সামাদ। সহযোদ্ধাদের সবাইকে পিছু হটার নির্দেশ দেন। কিন্তু সহযোদ্ধারা অনড়। দলনেতাকে ছেড়ে তারা পিছু হটতে রাজি নন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট সামাদ চেঁচিয়ে বললেন, 'দেখ, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সবাই মরব। আর যদি তোমরা পিছু হটো তাহলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমার কাজ আমাকে করতে দাও।'

বাধ্য হয়েই পিছু হটলেন বাকি মুক্তিযোদ্ধারা। আশফাকুস সামাদ তখন একাই ৩টি মেশিনগান নিয়ে একবার শিমুলতলা, একবার বাঁশঝাড়ে ছুটে এসে হানাদারদের জবাব দিচ্ছিলেন। তার অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণে ঈদের দিনের ভোরে হানাদাররা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কিন্তু এক সময় ভোরের আলোতে তারা চিহ্নিত করে ফেলে আশফাকুস সামাদের অবস্থান। হানাদারদের ৩টি মেশিনগান পোস্টের সমন্বিত আক্রমণে এক পর্যায়ে প্রাণ হারান তিনি। একটু দূরে অবস্থান করা মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক দেখলেন, আশফাকুস সামাদের হেলমেট ফুটো করে কপালে ঢুকে গেছে শত্রুর গুলি।

ঈদের দিন আশফাকুস সামাদের দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরদিন ২১ নভেম্বর ভোরে রায়গঞ্জ সেতুর কাছে পাওয়া যায় আশফাকুস সামাদের মরদেহ। পকেটে পড়ে আছে ঈদের দিনের সকালের নাস্তা হিসেবে রাখা ২টি রুটি ও কিছুটা হালুয়া।

৬ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার সামরিক কায়দায় ডান হাত কপালে তুলে স্যালুট করলেন আশফাকুস সামাদকে। লালমনিরহাট মসজিদের পাশে জানাজার পর ৪১ বার গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে বেজে উঠে মার্চ পোস্ট। সবার চোখেই তখন চিকচিক করছে জল।

মুক্তিযুদ্ধের ঈদে আরেক দুর্ধর্ষ যুদ্ধ ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের হাতীবান্ধা যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন শহীদ হাবিলদার রঙ্গু মিয়া বীর বিক্রম ও নায়েব সুবেদার লুৎফর।

বেশ কয়েক দফা যুদ্ধের পরও মুক্তিবাহিনী দখল করতে পারেনি হানাদারদের শক্ত ঘাঁটি হাতীবান্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলেন, যদি ঈদের দিনে হানাদারদের ওপর আক্রমণ করা যায় তাহলে হানাদারদের শক্ত এই ঘাঁটিটি দখল করা সম্ভব হবে। কারণ ঈদের দিন বলে এদিন পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ বাদ দিয়ে কিছুটা অবসর সময় কাটাবে কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকবে।

ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে রঙ্গু মিয়াসহ মুক্তিযোদ্ধারা হাতীবান্ধায় চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈদের দিন রঙ্গু মিয়াসহ ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের ঘাঁটির উদ্দেশে রওনা হন। হাতীবান্ধা পৌঁছে তারা পজিশন নেন।

সকালের আলোতে হানাদারদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তা সত্ত্বেও সকাল ৮টার দিকে হানাদারদের ওপর হামলা চালান মুক্তিযোদ্ধারা। তখন ক্যাম্প থেকে হানাদারদের সেনা বদল হচ্ছিল। রঙ্গু মিয়ার আক্রমণে প্রথমেই হানাদার কোম্পানি কমান্ডার নিহত হয়। রঙ্গু মিয়ারা দেখলেন, এটিই বড় সুযোগ। ভয়াবহ আক্রমণ চালালেন তারা। তাদের আক্রমণে হানাদারদের ডান দিকের অবস্থান মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিন্তু হানাদারদের বাম দিকের অবস্থান ছিল বেশ উঁচুতে। সুরক্ষিত একটি বাঙ্কার থেকেই হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল।

ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান বুঝলেন, বাম দিকের বিওপিটি দখল না করলে কিছুতেই এখানেই থাকতে পারবেন না মুক্তিযোদ্ধারা। তখন রঙ্গু মিয়া ও লুৎফর বনিজের প্রাণের কথা না ভেবে হানাদারদের বাঙ্কার চার্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকেন। বাঙ্কারের কাছাকাছি এসে তারা গ্রেনেড ছুড়ে মারতেই হানাদাররা রঙ্গু মিয়া ও লুৎফরকে দেখতে পেয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। তীব্র গুলিবর্ষণেও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে হানাদারদের বাঙ্কার চার্জ করেন ২ জন। বেশ কয়েকটি বাঙ্কার এ সময় পুরোপুরি ধ্বংস হলেও বাকি হানাদারদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় এই ২ মুক্তিযোদ্ধার বুক।

এই ২ দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের ফলে সেদিন হানাদারদের শক্ত ঘাঁটি হাতীবান্ধা চলে আসে মুক্তিবাহিনীর দখলে। সেদিনের যুদ্ধে হতাহত হয় প্রায় দেড়শ হানাদার সেনা।

মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিন তথা আজকের দিনে ভারতীয় সীমান্তবর্তী সিলেটের জকিগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বাংলার নানা প্রান্তে ঈদের দিনের এমনই অসংখ্য যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যান বিজয়ের পথে।

তথ্যসূত্র:

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ১, ৬ ও ১১

গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে/ মাহবুব আলম

একাত্তরের ঈদের এই দিনে/ লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

5h ago