ব্ল্যাকআউটে তথ্য যাচাই, সাংবাদিকতার লড়াই ও যূথবদ্ধতার আখ্যান
জুলাইয়ের রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের কঠিন দিনগুলো সাংবাদিকতার জন্য ছিল ভয়ঙ্কর। মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজে থাকা প্রতিবেদক, আলোকচিত্রী ও ক্যামেরা পারসনদের দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতার ভেতর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যেমন ছিল, তেমনি ছিল সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অঘোষিত সেন্সরশিপ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চাপ।
নব ইতিহাস তৈরি করা চব্বিশের এই অভ্যুত্থানেই ডিজিটাল যুগে প্রবেশের পর সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ইন্টারনেট 'ব্ল্যাকআউট'র কবলে পড়ে বাংলাদেশ।
দমবদ্ধ ওই সময়ে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের কাজে কোন কোন কৌশল অবলম্বন করেছিলেন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকরা, কাজের ক্ষেত্রে কীভাবে তারা রচনা করেছিলেন সহযোগিতা ও যূথবদ্ধতার অনন্য এক আখ্যান, কীভাবেই বা তারা লড়াই চালিয়ে গেছেন অপতথ্যের প্রবল ঢেউয়ের বিরুদ্ধে—তার একটি চুম্বকাংশ উঠে এসেছে 'ব্ল্যাকআউট ক্রনিকেলস: হাউ জার্নালিস্টস অ্যান্ড অ্যাক্টিভিস্টস নেভিগেডেট দ্য ব্ল্যাকআউট' শীর্ষক আলাপচারিতায়।
আজ বুধবার রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে অনুষ্ঠিত এ আলাপচারিতায় অংশ নেন কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরার বাংলাদেশ প্রতিনিধি তানভীর চৌধুরী, আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকবিষয়ক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক শামীমা সুলতানা লাবু, নারীবাদী সংগঠন 'স্বয়ং'র কান্ট্রি লিড সুরভিতা বাসক ও ডেইলি স্টারের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক সাইম বিন মুজিব।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অদম্য সাহস, দৃঢ়তা ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে আন্দোলনের আলোকচিত্র, স্লোগান, গ্রাফিতি ও সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে ডেইলি স্টার আয়োজিত '৩৬ জুলাই: নির্ভীকদের অভিবাদন' শিরোনামের সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনীর অংশ ছিল এ আলোচনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচিতে দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ১৭ জুলাই প্রথমবার মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ রাখা হয়। অর্থাৎ ওই সময়টায় ইন্টারনেটে পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে বাংলাদেশ। পরে ইন্টারনেট খুলে দেওয়া হলেও ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম চালু হয় ৩১ জুলাই দুপুরে। এরপর ২ আগস্ট প্রায় ৭ ঘণ্টা মোবাইল ইন্টারনেটে ফেসবুক ও টেলিগ্রাম সেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল। সবশেষ ৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে বন্ধ করা হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। তার আগের দিনই বন্ধ করা হয়েছিল মোবাইল ইন্টারনেটও।
সেই কঠিন সময়ে সাংবাদিকদের মধ্যকার নেটওয়ার্কই 'সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল' বলে মন্তব্য করেন তানভীর চৌধুরী। এ ছাড়া, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এবং এএফপি বাংলাদেশের তৎকালীন ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলমের সহযোগিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা লোকাল সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করতাম। শফিক ভাই ওয়াজ হেল্পফুল। এজেন্সি ফুটেজ যা গেছে ওনার মাধ্যমেই গেছে।'
তানভীর চৌধুরী আরও বলেন, 'লোকাল কানেকশন বাইপাস করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কানেক্ট করার মতো ইক্যুইপমেন্ট আমাদের ছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে জ্যামারের কারণে সেটা পারতাম না।'
এ ছাড়া, সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করা নানা প্রতিবন্ধকতার প্রসঙ্গও উঠে আসে তানভীর চৌধুরীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, 'ফরেন মিনিস্ট্রি বলতো, আমরা ডিজইনফরমেশন ছড়াচ্ছি। আমরা কিছু প্রটোকল ফলো করতাম ফর আওয়ার সেফটি। যাতে করে কিছু হলে উই কুড মিট। লোকাল সাংবাদিকরা বেশি রিস্কে ছিলেন। তারাই বেশি রিস্ক নিয়েছেন।'
মাঠে কাজ করার সময় সতর্কতার অংশ হিসেবে সবসময় অবস্থান পরিবর্তনের কথা জানিয়ে তানভীর চৌধুরী বলেন, 'যেখানেই গেছি, লোকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে কানেক্টেড থেকেছি, তারা সতর্ক করেছেন।'
তিনি বলেন, 'আবার আমরা এমন অনেক ফুটেজ পেয়েছি, যা আমরা পাঠাতে পারিনি। অনেক প্যাকেজ করেছি, যা অনএয়ার করতে পারিনি। কারণ যে ব্যান্ডউইথ দরকার ছিল তা পাইনি।'
ব্ল্যাকআউট চলাকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে কদরুদ্দীন শিশির বলেন, 'বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ফুটেজ প্রচার করতে পারছিল না। তাই আমরা নিজেরা সংবাদ প্রচার করা শুরু করি। ক্যাজুয়ালটির বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলাতে যোগাযোগ করে ইনফো কালেক্ট করা হতো। বিশেষ করে অন ডিউটি ডক্টর কিংবা হসপিটাল অথরিটি থেকে তথ্য নেওয়া হতো। কিন্তু পরবর্তীতে তারাও নিহতদের সংখ্যা বলা বন্ধ করে দেয়। কারণ, তাদেরকেও চাপ দেওয়া হয়েছিল। সরকারের জায়গা থেকে নিহতের সংখ্যা ডাউনপ্লে করার চেষ্টা ছিল। তবে আমাদের রেকর্ডের কারণে তারা হয়তো সেভাবে সফল হতে পারেনি।'
এরপর থেকেই তাদের ওপর চাপ শুরু হয় জানিয়ে শিশির আরও বলেন, 'যখন কোথাও ইন্টারনেট নেই, তখন আমাদের ইন্টারনেট ছিল। বিধায় অন্যান্য টিভি-পত্রিকা চলে আসতো আমাদের অফিসে। আমাদের দুটো পিসি ডেডিকেটেড করে দেওয়া হয়েছিল তাদের জন্য।'
ইন্টারনেট ফেরার পর 'বন্যার মতো' অপতথ্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে বলে মন্তব্য করেন শিশির। বলেন, '৩ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ডিজইনফরমেশন চরম মাত্রায় বেড়ে যায়। কোঅর্ডিনেটেড একটা ক্যাম্পেইন চালু হয়। তারা (আওয়ামী লীগ) শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ভিডিও-ছবিগুলো জামায়াত-শিবিরের হামলা হিসেবে চালাতে থাকে। পরদিন শিক্ষার্থীদের মাঠে না নামানোর জন্য এটা ছিল তাদের একটা ইফোর্ট। তখন ৫০টির বেশি ভিডিও আমি ডিবাংক করেছি। অনেক ভিডিও পারিনি।'
আলাপচারিতায় সাংবাদিক শামীমা সুলতানা বলেন, 'ব্ল্যাকআউট হওয়ার পরও আমাদের আগের মতো করেই সব কাভার করতে হতো। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মোবাইল কল কিংবা টেক্সটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতাম।'
তিনি বলেন, 'টিভি ফুটেজ ক্যারি করার জন্য যে ব্যাকপ্যাক সেটা ব্যবহার করা যাচ্ছিল না ইন্টারনেট না থাকায়। তাই ক্যাবল কানেকশনের মাধ্যমে ফুটেজ ক্যারি করতে হতো। পরবর্তীতে ক্যাবল লাইনও কেটে দেওয়া হয়। পরে বাড়তি মেমোরি কার্ড ক্যারি করতাম। ফুটেজ নিয়ে কাউকে দিয়ে অফিসে পাঠিয়ে দিতাম।'
আর সে সময় চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরাও নানামুখী চাপে থাকতেন বলে উল্লেখ করেন শামীমা। বলেন, 'শেষ দিকে আমাদের টক শোগুলোতে কে বা কারা গেস্ট হবে, আলোচনা কতখানি হার্শ হচ্ছে, সেটা ওপর থেকে বলে দেওয়া হতো। তবু নিউজরুম ম্যানেজাররা চেষ্টা করতেন, যতখানি বাইপাস করা যায়।'
শামীমা আরও বলেন, 'আমরা নয় দফা দাবি জানলাম কষ্ট করে। তবে অফিস তা অন এয়ার করতে পারেনি চাপের কারণে। আমাদের সম্প্রচার ২২ মিনিটের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তা একটা চাপ তৈরি করেছিল।'
আলাপে ব্ল্যাকআউটের ভেতরে দেশে সত্যিকার অর্থে কী ঘটছে, সেই খবর বাইরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন সুরভিতা বাসক। বলেন, 'আমাদের সংগঠনটি একটি নারীবাদী সংগঠন। কিন্তু সময়ের দাবি আমাদের সবাইকে সাংবাদিকে রূপান্তর করেছিল সে সময়।'
আলোচনায় সংঘাত-সহিংসতার ভেতর মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সাইম বিন মুজিব। বলেন, 'কাভার করতে গিয়ে আমরা নানাভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছি। মাঠে ছাত্রলীগ থেকেও চাপে পড়েছি, আবার শিক্ষার্থীদের থেকেও চাপে পড়েছি৷ মাঠে থেকেই আমাদের আবিষ্কার করে নিতে হয়েছে সেফটি রুট কোনটা।'
সাইম আরও বলেন, 'ইন্টারনেট চলে যাওয়ার সময়টাতেও আমরা কাজ বন্ধ রাখিনি। আর্কাইভিং শুরু করি। ভিডিও কালেক্ট করা বন্ধ করিনি। রেগুলার ভিডিও কালেক্ট করে তা সম্পাদনা করে রাখতাম। যাতে পরে বলতে পারি যে, এগুলো আমাদের প্রচার করতে দেওয়া হয়নি।'
তখন ইন্টারনেট না থাকায় ঢাকার বাইরের রিপোর্টারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ শুরু করার কথা জানান সাইম। বলেন, 'তারা (রিপোর্টাররা) কী দেখছে, কী পাচ্ছে, তা আমাদের ফোনে শোনাতেন। সেগুলা আমরা প্যাকেজে ব্যবহার করেছি।'
সে সময় অফিসের পাশেই এক সহকর্মীর বাসায় ক্যাম্প অফিস স্থাপনের কথা জানান সাইম। বলেন, 'তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে আজ বাসায় গেলে কাল হয়তো অফিসে আসার পরিস্থিতি নাও থাকতে পারে।'
অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়টিকে একটি 'ঘোরলাগা' অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন এই সাংবাদিক। বলেন, 'এত রক্ত, মৃত্যু, সংঘাত, নির্মমতা নেওয়া যাচ্ছিল না। সবসময় মনে হতো, একটা ঘোরলাগা অবস্থার ভেতর আছি। এ অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো না।'
আলাপচারিতার পরের পর্বে দর্শক-শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন আলোচকরা।
সবশেষে প্রলম্বিত জুলাইয়ের অগ্নিগর্ভ দিনগুলো নিয়ে তৈরি 'দ্রোহের জুলাই: সংবাদে-সংগ্রামে' শীর্ষক তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
আলোচনা সঞ্চালনা করেন ডেইলি স্টারের সাংবাদিক নাজিবা বাশার।
Comments