জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ডেইলি স্টারের প্রদর্শনী

‘বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই’

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ডেইলি স্টারের প্রদর্শনী
‘৩৬ জুলাই: নির্ভীকদের অভিবাদন’ শীর্ষক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আয়োজনে জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা যোগ দেন। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নব ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া 'নতুন বাংলাদেশে' বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই জারি রাখার আহ্বান এসেছে দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রদর্শনী থেকে।

চব্বিশের গণআন্দোলনের আলোকচিত্র, স্লোগান, গ্রাফিতি ও সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে আয়োজিত এ প্রদর্শনীর আলোচনা পর্বে অংশ নেওয়া একজন বক্তা উপস্থাপন করেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পক্ষ থেকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চিরকালীন প্রচেষ্টার বিষয়টি। প্রখ্যাত চেক লেখক মিলান কুন্ডেরার 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং' উপন্যাসের বিখ্যাত সেই লাইনটি উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, 'ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই।'

ছেলেকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

তাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সম্ভাব্য যেকোনো ধরনের অন্যায্য ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রক্তাক্ত জুলাইয়ের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি।

শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে '৩৬ ডেইজ অব জুলাই: স্যালুটিং দ্য ব্রেভহার্টস' শীর্ষক সাতদিনের এই প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অদম্য সাহস, দৃঢ়তা ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে দেশের শীর্ষ এই ইংরেজি দৈনিকটি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

এতে উঠে এসেছে, কীভাবে ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরা; বিশেষ করে আলোকচিত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও বিশ্বের পাঠকের কাছে শিক্ষার্থী এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মত্যাগ, সাহসিকতা ও বীরত্বের গল্পগুলো তুলে এনেছেন।

এদিন বিকেল সোয়া ৩টায় ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশ মাহফুজ আনাম প্রদর্শনী উদ্বোধন করে বলেন, 'যাদের আত্মত্যাগে একটা নিষ্পেষণের কবল থেকে আমাদের মুক্তি এসেছে, তাদের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই এ আয়োজন।'

জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করেন নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

উদ্বোধনের পর আগত অতিথি ও দর্শনার্থীরা ডেইলি স্টার সেন্টারের নিচতলা ও দোতলায় প্রদর্শনীস্থল ঘুরে দেখেন। বিকেল পৌনে ৪টায় শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান।

আলোচনা অনুষ্ঠানের ‍শুরুতে প্রলম্বিত জুলাইয়ের অগ্নিগর্ভ দিনগুলো নিয়ে তৈরি 'দ্রোহের জুলাই: সংবাদে-সংগ্রামে' শীর্ষক তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।  

পরে আলোচনায় অংশ নেন গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্য, আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী ও সমন্বয়কসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা।

ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

অনুষ্ঠানে অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা শামসি আরা জামান বলেন, 'স্বাধীনতার জন্য কাউকে না কাউকে তো জীবন দিতেই হবে। আমার ছেলের প্রাণ গেছে। আরও অনেকের গেছে। এরা জীবন দিয়ে হলেও অন্তত আমাদের কিছু দিয়ে গেছে।'

স্বৈরাচারের দোসরদের আর ছাড় দেওয়া যাবে না মন্তব্য করে ছেলে হারানো এই মা বলেন, 'এই হত্যাকাণ্ডের বিচারটা যেন তাড়াতাড়ি হয়। আমরা আশাবাদী। খারাপ কিছু দেখতে চাই না। আর বৈষম্য করা যাবে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।'

ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

শামসি আরা জামান আরও বলেন, 'গত ১৫ বছরে বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের দালালি করেছে, দোসর হয়ে কাজ করেছে।'

এভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারকে যে গণমাধ্যমগুলো 'আরও খুনি ও বেপরোয়া হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে' তাদের চিহ্নিত করার তাগিদ দেন প্রিয়র মা। বলেন, 'গণমাধ্যমগুলোকে আরও জনবাদ্ধব হয়ে ওঠা জরুরি।'

প্রদর্শনীতে আসা নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতদের একাংশ। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

সেইসঙ্গে আন্দোলনে নিহত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানান শামসি আরা।

এরপর কথা বলেন আন্দোলনে শহীদ মায়া ইসলামের ভাগনে মো. আবু সাঈদ, আহত অন্তর ঢালীর বাবা হানিফ ঢালী ও গুলিতে চোখের আলো হারানো মুহাম্মদ ইমরান হোসেন। তাদের সবার কথায় উঠে আসে আন্দোলন চলাকালীন শহীদ পরিবারগুলোর ওপর তৎকালীন পুলিশ-প্রশাসনের নির্মম আচরণের কথা।

এছাড়া ইমরান নিজেরসহ এই গণআন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় অন্তর্বর্তী সরকারের 'অবহেলায়' অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, 'সরকার শুধু আশ্বাস দেয়। কিন্তু (হাসপাতালে দেখতে) আসে না।'

কথা বলেন শহীদ মো. সজলের ভাই আবুল বাশার অনিক। আন্দোলনের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতে তিনি দেশের জায়গায় জায়গায় শহীদদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন।

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন আগত দর্শকরা। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

পরে এই স্মৃতির গুরুত্ব প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন উল্লেখ করেন মিলান কুন্ডেরার প্রখ্যাত ওই লাইনটি। বলেন, 'আমরা কোনোভাবেই প্রলম্বিত যে জুলাই, রক্তাক্ত যে জুলাই সেটাকে ভুলে যাব না। প্রতি মুহূর্তে আমাদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।'

গীতি আরা নাসরীনের পর কথা বলেন শহীদ মামুন হোসেনের মা ফাতিমা খাতুন। নোয়াখালী থেকে আলোচনায় অংশ নিতে আসা ছেলে হারানো ফাতিমার বক্তব্য সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তীব্র কণ্ঠে এই নারী বলেন, 'ভবিষ্যতে আপনারা এই দেশে এমন স্বৈরাচারের জন্ম হতে দেবেন না।'

এছাড়া পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্য করে ফাতিমা বলেন, 'আপনারা আর কারও গোলাম হবেন না।'

আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আন্দোলন চলাকালীন আহতদের সেবায় নিয়োজিত নুসরাত তাসনিম অর্না, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মাসুদ রানা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়মা আহমেদ, ইউল্যাবের শ্যামলী সুলতানা, তিতুমীর কলেজের নীরব হাসান সুজন ও ইডেন কলেজের শাহীনূর সুমি।

মাসুদ রানা বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার সাধারণ মানুষকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত রাখার জন্য সব ধরনের ন্যারেটিভ জারি রেখেছিল।

সায়মা আহমদের ভাষ্য, চব্বিশের এই আন্দোলন কোনো নির্দিষ্ট একটি দল কিংবা গোষ্ঠীর ছিল না। তাই এতে অংশ নেওয়া প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা উচিত।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত দুটি ম্যাগাজিন হাতে প্রদর্শনীতে আগত এক শিশু। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

শ্যামলী সুলতানা মনে করেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি নিজস্ব চিন্তা-চেতনার সংস্কারও প্রয়োজন।

নীরব হাসান বলেন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে। এবার যেন তেমনটি না হয়।

শাহীনূর সুমির ভাষ্য, নতুন বাংলাদেশে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই যার যার অধিকার নিয়ে কথা বলতে দিতে হবে।

একইসঙ্গে এই বক্তারা প্রত্যেকে নতুন পরিস্থিতিতে বিভাজিত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে অভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তোলার আহ্বান জানান।

প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিমিন রহমান ও গ্রুপের হেড অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন জারিফ আয়াত হোসেন; মিডিয়াওয়ার্ল্ড লিমিটেডের অন্যতম পরিচালক রোমো রউফ চৌধুরী ও ইমরান ফয়েজ রহমান, প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান, বণিক বার্তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও সিইও দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন আগত দর্শকরা। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা ও সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, লেখক ড. শফিকুল ইসলাম, সাংবাদিক কাজল রশিদ শাহীন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ খান মোহাম্মদ রবিউল আলম এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নাভিন মুরশিদ।

ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমন্বয়ক নাঈম আবেদিন, ঢাকা কলেজের মইনুল ইসলাম ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারাবী জিসান।

প্রদর্শনী দেখতে আসেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার রুহুল কবির খান ও র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া উইং) মুত্তাজুল ইসলাম।

প্রদর্শনীটি ১ থেকে ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। পাশাপাশি প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলবেন সাংবাদিক, শিক্ষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

Comments

The Daily Star  | English

Indian Media Reporting on Bangladesh: Fake or Fact?"

Why is the Indian media's coverage of Bangladesh markedly different from that of Bangladeshi news outlets?

1h ago