মরজিনার সাফল্যের গল্প এখন গ্রামবাসীর মুখে মুখে
খুব বেশি আগের কথা নয়, স্বজন-প্রতিবেশীর সহায়তা ছাড়া সাত সদস্যের পরিবার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হতো। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার টেংরা গ্রামের সেই মরজিনা বেগম খুব অল্প সময়ে অন্যের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন।
তার সংসারের অভাব দূর হয়েছে, নেই পাঁচ সন্তানের পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা।
অল্প বয়সে বিয়ে হয় মরজিনার। দেখতে দেখতে বড় হয় পরিবার। চার মেয়ে ও এক ছেলেসহ সাত সদস্যের সংসারে বাড়তে থাকে ব্যয়। তার বড় মেয়ে সুমাইয়া শ্রীপুর রহমত আলী সরকারি কলেজে পড়াশোনা করছেন। আরেক মেয়ে সিনথিয়া অষ্টম শ্রেণিতে, সুরাইয়া তৃতীয় শ্রেণিতে এবং সামিয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান এখনো শিশু।
নিজের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলাতে মরজিনা লাউ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন। ৫০ হাজার টাকায় নিজের গহনা বিক্রি করে দেন, স্বামীর কাছ থেকে নেন আরও দেড় লাখ টাকা। দুই লাখ টাকায় ১০ বছর ব্যবহারের চুক্তিতে পাঁচ বিঘা জমি বর্গা নেন।
প্রথমে ২০০টি লাল তীর হাইব্রিড জাতের গাছ লাগান মরজিনা। এর মধ্যে ১৮০টি গাছে ফলন ভালো হয়। বর্তমানে তার গাছে প্রায় ছয় হাজার লাউ আছে। প্রতিদিনই ৫০ টাকা দরে ২০০ থেকে ২৫০টি লাউ বিক্রি করছেন। এতে তিনি দৈনিক ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন।
মরজিনা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত চার লাখ টাকার লাউ বিক্রি করেছি। আশা করছি, আরও ১৫ লাখ টাকার লাউ বিক্রি হবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে বাগানের সব কাজ করি। কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না, শুধু জৈব সার দেই। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে, আর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরিশ্রম করছি।'
লাউ চাষের পাশাপাশি মাছ চাষও শুরু করেছেন মরজিনা।
'কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতা পেলে চাষাবাদ আরও সহজ হবে,' বলেন তিনি।
জৈব সার তৈরি করতে স্থানীয় গরুর খামার থেকে গোবর সংগ্রহ করেন মরজিনা। কীটনাশকের ব্যবহার এড়াতে আক্রান্ত লাউ কেটে ফেলে দেন তিনি।
শ্রীপুর বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মরজিনা বেগমের বাগানের লাউগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি ভালো মানের। প্রতিদিন আমি তার কাছ থেকে লাউ কিনে বাজারে বিক্রি করি। তার লাউয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিষমুক্ত। ক্রেতারা একবার নিয়ে গেলে বারবার খোঁজ করেন।'
প্রতিবেশী রুবিনা খাতুন বলেন, 'আমি প্রায়ই মরজিনার বাগান থেকে লাউ কিনে আনি। তার লাউগুলো শুধু সুস্বাদু নয়, অনেক দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে। বাজারের লাউয়ের থেকে অনেক ভালো।'
'মরজিনা আপাকে দেখে আমিও বাড়ির আঙিনায় একটা লাউগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছি। এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য,' যোগ করেন তিনি।
মরজিনার স্বামী আখতারুজ্জামান কলের মিস্ত্রি। তবে তিনি স্ত্রীর কাজে নিয়মিত সময় দেন। আখতারুজ্জামান বলেন, 'মরজিনার পরিশ্রমই আমাদের ভাগ্য বদলেছে। আমার স্ত্রী সংসার চালাতে লাউ চাষ শুরু করেছিল, আমিও তাকে সহযোগিতা করি। এখন সে প্রতিদিন লাউ বিক্রি করে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছে। এই টাকায় সন্তানদের পড়াশোনা এবং সংসারের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই উপার্জন দিয়ে আরও ভালো কিছু করার পরিকল্পনা আছে।'
মরজিনা জানান, কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতার জন্য ভবিষ্যতে তারা যোগাযোগ করবেন।
উপজেলা তেলিহাটি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সরোয়ার হোসেন বলেন, 'দেড় শতাংশ জমিতে পুষ্টিবাগান তৈরি করলে আমরা সহযোগিতা করে থাকি। বড় বাগানগুলোতে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বলেন, 'সবজি চাষিদের সমস্যা সমাধানে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি।'
Comments