সমতলে পাহাড়ি জাতের কমলার উচ্চ ফলন
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সাতখামাইর পশ্চিমপাড়া এলাকায় কমলা চাষ করে সফল হয়েছেন চার উদ্যোক্তা। তারা আট বিঘা জমিতে দার্জিলিং ও মান্দারিন জাতের কমলা চাষ করেছেন।
সমতল লাল মাটিতে এ বছর কমলার বাম্পার ফলন এসেছে। সুমিষ্ট-রসালো কমলা কিনতে বাগানে ভিড় দেখা গেছে ক্রেতাদের।
উদ্যোক্তারা হলেন, ওয়ালিউল্লাহ বায়েজীদ, ফারুক আহমেদ, আবদুল মতিন ও আইনুল হক।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাগানের প্রবেশমুখে ১০-১২ জন ক্রেতার লাইন। ৩০ টাকার টিকিট কেটে তারা বাগানে প্রবেশ করছেন। দূর থেকেই চোখে পড়ে, বাগানের গাছে গাছে থোকায় থোকায় হলুদ ও সবুজ বর্ণের কমলা ধরে আছে। কেউ কেউ গাছ থেকে কমলা ছিঁড়ে খাচ্ছেন। বাগানে গাছের নীচে ছোট ছোট মই রাখা আছে। মই বেয়ে অনেকে নিজের পছন্দমত কমলা ছিঁড়ছেন। শিশুরাও বেশ আনন্দ পাচ্ছে এতে।
নিজ দেশে নিজ হাতে কমলা ছিঁড়ে খাওয়ার অনুভূতি স্বপ্নের মতো বলে জানিয়েছেন অনেকে।
দার্জিলিং জাতের কমলা আকারে বড়। মৌসুমের শেষ দিকে হওয়ায় প্রতিটি গাছে বিচ্ছিন্নভাবে শোভা পাচ্ছে কমলা। চায়না জাতের হলুদ সবুজ বর্ণের মান্দারিন কমলা থোকায় থোকায় ঝুলে গাছের ডালপালা নুইয়ে দিয়েছে।
ক্রেতা সাদিয়া সুলতানা বলেন, 'গাজীপুরের মাটিতে কমলার চাষ হচ্ছে, এটা অনেক আনন্দের। কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদানে কমলা উৎপাদন হচ্ছে।
একসময় ধারণা ছিল দার্জিলিং জাতের কমলা শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই চাষ হয়। সেই ধারনা পাল্টে গেছে।'
বাগান সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, দর্শনার্থীরাই কমলা কিনে নিয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের কাছে কমলা বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার ক্রেতার ভিড় হয় বেশি। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কমলা বিক্রি হয়। এর মাঝে দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি।
খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার মফিজুর রহমান বলেন, 'এক সহকর্মী জানান গাজীপুরে কমলা বাগান রয়েছে। আজ এসে বিস্মিত হয়েছি।'
শ্রীপুরের বাসিন্দা নুরে হাবীবা বলেন, 'ফেসবুকে এই কমলা বাগানের ভিডিও দেখে এসেছি।'
গার্ডেনার সবুজ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চার বন্ধু মিলে বাগান করার পরিকল্পনা করি। নাটোরের কৃষিবিদ গোলাম মাওলাসহ অভিজ্ঞ কয়েকজনের কাছ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে সেখানে বাগান শুরু করি। আট বিঘায় ১৫০টি কমলার চারা রোপণ করি। ১০০ দার্জিলিং এবং ৫০টি চায়না মান্দারিন জাতের চারা। বাগানে দার্জিলিং জাতের ৭০টি গাছে ফলন এসেছে। প্রতিটি গাছে কমপক্ষে ২০ কেজি পরিমাণ কমলা এসেছে। ৩০০ টাকা কেজি দরে দার্জিলিং কমলা বিক্রি করছি।'
উদ্যোক্তা ওয়ালীউল্লাহ বায়েজীদ বলেন, 'দার্জিলিং এবং চায়না মান্দারিন কমলা মূলত ভারত ও সিলেটের লাল মাটিতে উৎপন্ন হয়। ২০০০ সালে ঝিনাইদহে কমলার উৎপাদন দেখেছি। সেখান থেকেই কমলা চাষে উদ্যোগী হই। এখানে রোপণের পর উৎপাদনের প্রথম বছরেই দু-তিনটি কমলা এক কেজি পরিমাণ ওজনের হয়েছে। ২০২৩ সালেও দার্জিলিং ও মান্দারিন দুটো জাতেরই ভালো উৎপাদন হয়েছে।'
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'লাল মাটির জমি ফেলে না রেখে কৃষি অফিসের সহায়তায় কমলা উৎপাদন সম্ভব। পরিচর্যা ঠিকমত করতে পারলে দেশের বাইরে থেকে আনা কমলার যে গুণগত মান তার থেকে আমাদের দেশের কমলার গুণগত মান সেরা হবে।'
ওয়ালীউল্লাহ বায়েজীদ জানান, কমলার ফুল আসা থেকে শুরু করে ফল তোলা পর্যন্ত ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় না। ফুল আসার আগে গাছের সুস্থতায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়।
তিনি বলেন, '২০২১ সালে কমলার চাষ শুরু করেছি। এ বছর তৃতীয় ফলন। আট বিঘা পতিত জমি বছরে এক লাখ টাকায় লিজ নিয়েছি। আপাতত বছরে সাত লাখ টাকা খরচ করছি। গাছের মেয়াদ চার বছর। কমলা ১০ মাস বিক্রি করতে পারছি। আশাকরি লাভবান হব।'
সবুজ মিয়া আরও বলেন, 'উপজেলা কৃষি অফিসার হুমায়ুন কবীর একবার এসেছিলেন। বাগান পরিদর্শন করেছেন। ফলন ভালো হলে এসে দেখে যায়, পরে খোঁজ নেয় না। কৃষি অফিস থেকে গত তিন বছরে কোনো উপকরণ পাইনি। আমাদের বলেছিল কেঁচো সার তৈরির উপকরণ দেওয়া হবে। সেটাও পাইনি।'
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য চাষিকে কমলা চাষে উৎসাহিত করছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে কমলার চারা সরবরাহ করা হয়েছে। শ্রীপুর কমলা চাষে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জায়গা।'
গাজীপুরের কমলা চাষিরা গত তিন বছরে সরকারি সহযোগিতা পায়নি, এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রীপুরে মাল্টা বাগান রয়েছে, কিন্তু কমলা বাগান আছে তা জানা ছিল না। আমি শিগগির যাব। বাগান পরিদর্শন করে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।'
Comments