আর্থিক সংকটে পলিসি বন্ধ করছেন বিমা গ্রাহক

বিমা পলিসি
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর প্রায় তিন লাখ ৪৭ হাজার পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, গ্রাহকদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, রাজনৈতিক পালাবদল ও দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বারবার বন্যার কারণে মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে তারা পলিসি চালিয়ে যেতে পারেননি।

খাত সংশ্লিষ্টরা আরও মনে করছেন, এ ছাড়া অস্পষ্ট তথ্য ও দেশের বিমা খাতের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেও পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে।

বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট ৩৬টি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রায় ১৫ লাখ ৪২ হাজার গ্রাহকের পলিসি বন্ধ হয়েছে। চলতি বছরে সেই অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে পলিসি বাতিলের শীর্ষে আছে ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। এই সময়ে কোম্পানিটির ৫৬ হাজার ৩৩৮ জন গ্রাহক বিভিন্ন ধরনের বিমার পলিসি দেওয়া বন্ধ করে দেন।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ও পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

চতুর্থ অবস্থানে আছে প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স পিএলসি এবং কোম্পানিটির ২৩ হাজার ২৩টি পলিসি বন্ধ হয়েছে। এছাড়া আলফা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের ২১ হাজার ৯১৭টি লাইফ পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে।

একটি পলিসি তখন বন্ধ হয়, যখন একজন পলিসিহোল্ডার সময়মতো প্রিমিয়াম জমা দিতে পারেন না। ফলে বিমা কভারেজ বাতিল হয়ে যায়।

বিমা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স একাডেমির পরিচালক এস এম ইব্রাহিম হোসেন বলেন, 'পলিসি বন্ধ হওয়া গ্রাহক ও বিমা কোম্পানি উভয়ের জন্য খারাপ।'

তিনি বলেন, পলিসি বন্ধ হলে একজন গ্রাহক অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য বিমা কোম্পানি থেকে যে সুযোগ পেতেন, সেই সুযোগ হারান। একই সঙ্গে এটি বিমা কোম্পানিগুলোর জন্য রাজস্ব ক্ষতি এবং কোম্পানির আর্থিক স্থিতিশীলতা ও গ্রাহক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তবে ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার সাধু হারিয়ে যাওয়া গ্রাহকের 'বড় অংশ' ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

তিনি বলেন, 'গ্রাহকরা অনেক সময় নানা কারণে আর্থিক সংকটে পড়েন। ফলে তারা সময়মতো প্রিমিয়ামের টাকা পরিশোধ করতে পারেন না।'

বন্ধ হওয়া পলিসির পরও সেপ্টেম্বরে ডেল্টা লাইফের প্রায় ১২ লাখ ৪৩ হাজার পলিসি ছিল।

তিনি বলেন, 'তিন থেকে চার মাস পর তাদের একটি বড় অংশ চাঙ্গা হয়ে উঠবে। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।'

উত্তম কুমার সাধু বলেন, বন্ধ হওয়া পলিসি আবার চালু করতে পুরস্কার ও প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলাফল ডিসেম্বরের শেষ দিকে পাওয়া যাবে।

আলফা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নূর আলম সিদ্দিকী অভি বলেন, পলিসি বন্ধ হওয়ার মূল কারণ আর্থিক সংকট।

তিনি বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক মানুষ এখন আর্থিক সংকটে আছেন।'

'অনেক বিমা এজেন্ট কোম্পানি পরিবর্তন করছে এবং তাদের গ্রাহকদের নতুন কোম্পানিতে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেও অনেক পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেক পলিসিহোল্ডার শুরুতে পলিসি কিনতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে দেখা গেছে সেগুলো তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এ কারণেও কিছু পলিসি বন্ধ হয়েছে।'

প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জালালুল আজিম বলেন, পলিসি বন্ধের অন্যতম কারণ ছিল জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী বিক্ষোভ। এটি মানুষের আয়ে প্রভাব ফেলেছে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে শ্লথ করে দেয়।

তিনি জানান, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ অনেক এলাকায় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বন্যার কারণে এজেন্টরা সময়মতো অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম আদায় করতে না পারায় পলিসি ত্রুটি দেখা দেয়।

বিলম্ব ফি দিয়ে এসব পলিসি পুনরায় চালু করা যায় বলে উল্লেখ করেন জালালুল আজিম। তিনি বলেন, গ্রাহককে পলিসি নবায়নে উৎসাহিত করতে তারা চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিলম্ব ফি মওকুফ করেছেন।

ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাজিম উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি তাদের অনেক গ্রাহকের পলিসির ম্যাচিউর হয়েছে, কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো তাদের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিমা খাতে।

তিনি বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক গ্রাহক বিমা প্রিমিয়াম জমা দেননি এবং অনেক পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে।

তার ভাষ্য, এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা সংসারের খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে অনেকে সময়মতো প্রিমিয়াম জমা দিতে পারছেন না, এতে পলিসি ত্রুটি হচ্ছে।

বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম গত বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া পলিসির সংখ্যা কমাতে তারা বিভিন্নভাবে বিমা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছেন।

তিনি বলেন, এছাড়া যেসব কোম্পানির পলিসি ত্রুটির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেসব প্রতিষ্ঠানকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে ২৬ লাখের বেশি বিমা পলিসি বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০৯ সালে মোট পলিসির সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি ১২ লাখ, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫ লাখ ৮৮ হাজার।

Comments

The Daily Star  | English

Students suffer as NCTB fails to deliver books

Only 37% of 40.15cr textbooks distributed till first half of Jan

11h ago