একদিনে দেখতে পারেন বরিশালের যেসব দর্শনীয় স্থান
নদী, খাল আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসমৃদ্ধ জেলা বরিশাল। শুধু তাই না, বরিশালকে বলা হয় প্রাচ্যের ভেনিস। কীর্তনখোলা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ শহরে রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান।
হাতে যদি সময় থাকে মাত্র একদিন, তবুও ঘুরে দেখতে পারেন বরিশালের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান।
বরিশাল শহরের একদম প্রাণকেন্দ্র বগুড়া রোডে অবস্থিত অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। বিশাল দৃষ্টিনন্দন এই গির্জায় শহরের যেকোনো জায়গা থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়।
স্থানীয়ভাবে এটি 'লাল গির্জা' নামেও পরিচিত। ১২১ বছরের পুরোনো এ গির্জার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯০৩ সালে এবং কয়েক ধাপে এর কাজ শেষ হয়। গির্জাটির মূল কাঠামো ৪২ মিটার লম্বা এবং ২২ মিটার চওড়া, যার সঙ্গে পূর্বদিকে একটি অর্ধ-বৃত্তাকার বর্ধিত অংশ যুক্ত আছে। গির্জার প্রার্থনাকক্ষ প্রায় ৫০ ফুট উঁচু।
গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত প্রার্থনাকক্ষ এ গির্জার প্রধান আকর্ষণ। গির্জাটি কাঠ, মার্বেল টাইলস, টেরাকোট এবং লাল ইট দ্বারা নির্মিত। গির্জাটি একতলা হলেও এর উচ্চতা প্রায় পাঁচ তলার সমান।
এ গির্জায় এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঘণ্টা দিনে সাতবার বাজে, যা পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে গির্জাটি বিকেল চারটা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
বজ্রমোহন কলেজ ক্যাম্পাস
অক্সফোর্ড মিশন চার্চ ঘুরে হেটে অথবা রিকশায় যাওয়া যেতে পারে বিএম কলেজ মানে বজ্রমোহন কলেজে। এ কলেজে কবি জীবনানন্দ দাশের অনেক স্মৃতি রয়েছে।
কলেজের লাল-সাদা রঙের মূল দোতলা ভবন এক চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এর প্রধান ফটকে লেখা 'সত্য প্রেম পবিত্রতা'। ভবন পেরোলেই মাঠ। আর তার এক কোনায় জীবনানন্দ দাশ চত্বর। এছাড়াও কলেজে কবির নামে ক্যাফে জীবনানন্দ, জীবনানন্দ দাশ হিন্দু ছাত্রাবাস রয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ এই কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং এখানেই শিক্ষকতা করেছিলেন। কলেজ ক্যাম্পাসটি অনেক সুন্দর চাইলে এখানে কিছু সময় কাটাতে পারেন।
লাকুটিয়া জমিদার বাড়ির
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলির মধ্যে লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি অন্যতম। এটি শহর থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বজ্রমোহন কলেজ ঘুরে জনপ্রতি ৪০ টাকা ভাড়ায় ৩০ মিনিটে অটোরিকশায় এখানে যাওয়া যায়।
জমিদার রাজচন্দ্র রায় আনুমানিক ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল সদর উপজেলার লাকুটিয়া গ্রামে এ জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর পাশাপাশি ইউরোপীয় স্থাপত্যের ছোঁয়াও রয়েছে নকশায়। বাড়ির মূল কাঠামোটি দোতলা। সেখানে রয়েছে কারুকাজ করা দরজা, জানালা, নকশা করা ছাদ ও বিস্তৃত বারান্দা। বাড়ির অঙ্গনে আছে বিশাল এক পুকুর এবং সুন্দর উদ্যান।
৩০০ বছরের প্রাচীন লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি বাংলার জমিদারি প্রথা ও স্থাপত্যশৈলীর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। বর্তমানে এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
বারো আউলিয়ার দরবার
লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি ঘুরে বরিশাল শহরে এসে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে যেতে পারেন বারো আউলিয়ার দরবারে। শহর থেকে এর দুরত্ব ২১ কিলোমিটার। দরবারটি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। অটোরিকশা বা বাসে এক ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টায় এখানে আসা যায়।
বারো আউলিয়ার দরবার এক ঐতিহাসিক জায়গা, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিমরা নামাজ আদায় করে, হিন্দুরা পুজা দেয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎকৃষ্ট এক উদাহরণ এ দরবার।
দরবারে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়বে পাকুড় গাছের মাঝে এক অদ্ভুত আকৃতির সুড়ঙ্গ। এ সুড়ঙ্গ দিয়েই মাজারের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশপথের ডান দিকে রয়েছে লম্বা আকৃতির এক কালো পাথর। কেউ কেউ এটিকে শিব পাথর বলেন। আর দরবারের পূর্বপাশে রয়েছে নারীদের নামাজের স্থান।
এ দরবার সম্পর্কে কথিত আছে, ইসলাম প্রচারে জন্য ১২ জন আউলিয়া এখানে এসেছিলেন। সেই সুবাদে চন্দ্রদ্বীপের রাজা তাদের জন্য উপঢৌকন পাঠান। কিছুদিন যেতেই আবার উপহার ফেরত চান জমিদার। উপহার দিয়ে ফেরত নেওয়ার এই হীনমন্যতা মেনে নিতে পারেননি তারা। তাই সিদ্ধান্ত নেন চলে যাবেন। তবে যাওয়ার আগে অলৌকিক ক্ষমতায় মাটির সুড়ঙ্গ থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, পিতলের থালা, কাপড়, খাদ্যশস্য, জীবন্ত ঘোড়া উগড়ে দিয়ে সেই সুড়ঙ্গ ধরেই গায়েব হয়ে যান তারা। খবর শুনে জমিদার ঘোড়ার বহর ছুটিয়ে আসেন ঘটনাস্থলে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে যতটুকু এলাকায় আউলিয়াদের পা পড়েছে, সেই জমি খাজনামুক্ত করে দেন। সুড়ঙ্গের চারপাশে তুলে দেন প্রাচীর। সেই থেকে এটি বারো আউলিয়ার দরবার নামে পরিচিত।
কীর্তনখোলা নদীর পাড়
বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে গেলে অবশ্যই ভালো লাগবে। নদীর শান্ত, শীতল পানির স্পর্শ নিয়ে যখন বাতাস আপনার গায়ে এসে লাগবে, তখন প্রফুল্ল হয়ে যাবে মন।
বরিশাল শহরের অদূরেই এ জায়গাটি। সর্বোচ্চ ৬০ টাকা ভাড়ায় রিকশা করে এখানে আসা যায়। স্থানীয়রা এ জায়গাকে ত্রিশ গোডাউন বলে। কেউ কেউ আবার রিভারভিউ পার্কও বলে। এখানে বধ্যভূমিও রয়েছে। সন্ধ্যার দিকে এখানে নানান মুখরোচক খাবারের পসরা বসে। চাইলেই স্বাদ নিতে পারেন সেসব খাবারের।
এসব জায়গা ঘুরে হাতে যদি আরও সময় থাকে তাহলে শহরের বেলস পার্ক, দুর্গাসাগর দিঘী, গুঠিয়া মসজিদ ঘুরতে পারেন। আর সময় না থাকলে কীর্তনখোলা নদীর পাড় দিয়েই শেষ করতে পারেন একদিনের বরিশাল ভ্রমণ।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বরিশালে সড়কপথ, নৌপথ ও আকাশপথ তিনভাবেই যাওয়া যায়। অর্থাৎ বাস, লঞ্চ অথবা উড়োজাহাজে যেতে পারবেন।
তবে বরিশাল যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও রোমাঞ্চকর উপায় হলো লঞ্চ। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বরিশালের উদ্দেশে লঞ্চ চলাচল করে। ডেক, কেবিন, এসি কেবিন, ফ্যামিলি কেবিনভেদে ভাড়া ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বরিশাল যাওয়ার উন্নতমানের সবচেয়ে ভালো লঞ্চগুলোর মধ্য রয়েছে সুন্দরবন-১৫, ১৬, প্রিন্স আওলাদ-১০, পারাবত-১২, ১৮, এডভেঞ্চার-১, মানামী, সুরভী-৭, পটুয়াখালী-২, এমভি ফারহান।
এছাড়া, ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ এবং মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বরিশালের বাস চলাচল করে। পদ্মাসেতু হয়ে বাসে বরিশাল যেতে অল্প সময় লাগে। এসি, নন-এসিভেদে এসব বাসের ভাড়া ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
এছাড়া দ্রুত বরিশাল যেতে চাইলে উড়োজাহাজে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে প্রতিদিন বরিশালের ফ্লাইট রয়েছে। ফ্লাইটে সর্বনিম্ন সাড়ে ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার টাকায় মাত্র আধাঘণ্টায় বরিশাল আসা যায়। তবে ফ্লাইটের সময় ও সিটের ধরন অনুযায়ী ভাড়া পরিবর্তন হতে পারে।
যেখানে থাকবেন
বরিশাল শহরে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল রয়েছে। এর মধ্য হোটেল এরিনা, গ্রান্ড পার্ক, হোটেল রোদেলা, হোটেল এথেনা ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল সেডোনা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শহরের আশেপাশে বেশকিছু সাধারণ মানের হোটেল রয়েছে। এগুলোতে থাকতে হলে এসি, নন-এসিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাভেদে ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় থাকা যায়।
যা খাবেন
বরিশালের সাধারণ মানের হোটেলগুলোতে সব ধরনের দেশী খাবার পাওয়া যায়। তবে বরিশালের গৌরনদী ও মলিদার দধি খুবই বিখ্যাত।
Comments