খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরায় বোরো চাষ নিয়ে অনিশ্চয়তায় প্রায় অর্ধ লাখ কৃষক

ফাইল ফটো | সংগৃহীত

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বাসিন্দা উল্লাস বিশ্বাস নিশ্চিত নন চলতি মৌসুমে তিনি বোরো ধান চাষ করতে পারবেন কি না। তার পাঁচ বিঘা জমি এখনো পানিতে নিমজ্জিত।

রংপুর গ্রামের বিল ডাকাতিয়া এলাকার এই কৃষক ২০২২ সালের বোরো মৌসুমে ১০৫ মণ ধান ঘরে তুলেছিলেন। পরের বছর, তিনি দেড় বিঘায় মাত্র ৩০ মণ চাষ করতে পারেন। তখনো তার অবশিষ্ট জমি জলাবদ্ধ ছিল।

ডুমুরিয়া উপজেলার কিছু কিছু আবাদি জমিতে এখন কোমর-সমান পানি। কেবল রংপুর নয়, এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে রূপরামপুর, শালুয়া, মিক্সি মিল ও রুদাঘোড়া।

'পানি কবে নামবে আমরা জানি না,' গত ৫ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন উল্লাস।

আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে যদি চাষ শুরু করা না হয়, তাহলে কৃষকরা বোরো মৌসুম ধরতে পারবেন না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার ১০টি উপজেলার অন্তত ৯৬ হাজার হেক্টর কৃষি জমি এখনো পানির নিচে। ফলে বোরো চাষ নিয়ে অনিশ্চয়তায় প্রায় অর্ধ লাখ কৃষক।

এই ৯৬ হাজার হেক্টর জমির দুই-তৃতীয়াংশ বোরো চাষে এবং বাকিটা মাছ চাষে ব্যবহৃত হয়। প্রবল বর্ষণে আগস্টের শেষ দিকে এসব এলাকা তলিয়ে যায়।

এই সময় উল্লাসের পরিপক্ব ফসল নষ্ট হয়ে যায়, ভেসে যায় মাছের ঘের। এতে তার ক্ষতি হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। উল্লাসের আশা ছিল বোরো মৌসুমে এই লোকসান পুষিয়ে নেবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, 'বোরো এখন ১১০০ থেকে ১৪০০ টাকা প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে। আমি যদি পুরো পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে পারি, তাহলে অন্তত এক লাখ টাকা আয় করতে পারবো।'

জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন রংপুর গ্রামের প্রায় সাড়ে চার হাজার কৃষক।

ওই এলাকার আরেক কৃষক সুভাষ সরকার বলেন, 'আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পানি না নামলে এই বছর বোরো ধান চাষ করতে পারবো না।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার প্রায় ২০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি পানিতে নিমজ্জিত। যার মধ্যে কেবল ডুমুরিয়া উপজেলায় তলিয়ে গেছে ১১ হাজার হেক্টর জমি।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনশাদ ইবনে আমিন জানান, সাধারণত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে বোরো মৌসুম শুরু হয়।

'শিগগির আবাদি জমি থেকে পানি নিষ্কাশন করে চাষযোগ্য করে তুলতে হবে,' বলেন তিনি।

মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী, হরি, শৈলমারী ও সালতার নদীতে ভারী পলির পড়ায় খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরার ১০টি উপজেলার অন্তত ৬০টি বিল পানিতে টইটম্বুর। আগস্টের শেষ দিকে এই অঞ্চলটি বন্যাকবলিত হয়। এতে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যশোরের ভবদহ এলাকার প্রায় ৩৫ হাজার কৃষক অন্তত ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেন।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখর চন্দ্র রায় জানান, তার ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের কৃষি জমি এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মতিয়ার রহমান জানান, তার বাড়ি শিরসুনি গ্রামে। তিনি সাড়ে চার বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেন এবং এই আয়ের ওপর তার সাত সদস্যের সংসারের ব্যয় নির্ভরশীল। বছরের বাকি সময় এই জমি মাছ চাষে ব্যবহার করা হয়।

'সাধারণত, পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত চাল রেখে আমি ২০ থেকে ২৫ মণ ধান বিক্রি করি। সেই টাকা সংসারে ব্যয় করি। আগামী পুরো বছর হয়তো আমাকে চাল কিনতে হতে পারে,' বলেন তিনি।

মণিরামপুর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের কৃষক প্রভাস বিশ্বাস জানান, তার দুই বিঘা জমি এখনো জলাবদ্ধ।

তিনি বলেন, 'গত বছর আমি প্রায় সাত মণ বোরো ধান ঘরে তুলেছিলাম। আমার পরিবারে চারজন সদস্য। সাত মণ ধান পাওয়ায় সংসার চালানো কিছু সহজ হয়েছিল। এই বছর যদি ধানের আবাদ করতে না পারি, তাহলে তিনবেলা খাবার জোগানো কঠিন হয়ে যাবে।'

খুলনার পানি কমিটির সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, পলি জমে ডুমুরিয়া উপজেলার ১১টি নদীর সবকটি মৃতপ্রায়। এ ছাড়া, অনেক স্লুইস গেট ভেঙে গেছে, ফলে পানি সরছে না। খুলনার এই তিন জেলার জলাবদ্ধতা যদি দূর না হয়, চলতি মৌসুমে বোরো চাষ অসম্ভব হবে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা চলছে জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'বিএডিসির ২৫টি পাম্প দিয়ে কৃষি জমি থেকে পানি সেচে নদীতে ফেলা হচ্ছে। শিগগির আরও ১৫টি পানির পাম্প স্থাপন করা হবে। কৃষি জমি থেকে জলাবদ্ধতা দূর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সমরেন বিশ্বাস জানান, গত কয়েক বছরে ভবদহ এলাকায় বোরো চাষের প্রসার ঘটেছে। এই বছর পরিস্থিতি খুব খারাপ। সমস্ত আবাদি জমি পানির নিচে। অনেক আবাসিক এলাকাও বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে পানি কমে গেলে চাষিরা বোরো ধানের আবাদ করতে পারবেন। অন্যথায়, যশোরের প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমি এই মৌসুমে অনাবাদি থেকে যেতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Muhammad Yunus returns after COP29

Chief adviser returns home after joining COP29 in Baku

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus returned home this evening wrapping up his Baku tour to attend the global climate meet Conference of Parties-29 (COP29)

2h ago