পুঁজিবাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না কেন

পুঁজিবাজার
আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

শেয়ারবাজারের সূচক গত দুই মাস ধরে নিম্নমুখী অবস্থানে আছে। যদিও আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সূচকের সাময়িক উত্থান হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা দ্রুত নেমে যায়।

শেয়ারবাজারের এই পতনের জন্য বিশ্লেষকরা কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই কারণগুলো হলো- ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে কেনা শেয়ার বিক্রি, একের পর এক শ্রমিক অসন্তোষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়া।

বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স মাত্র চার দিনের ব্যবধানে ৭৮৬ পয়েন্ট বা ১৫ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে প্রধান সূচক গতকাল পর্যন্ত ৮৪৬ পয়েন্ট বা ১৪ শতাংশ কমে ৫ হাজার ১৬৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, 'শেয়ারবাজারে দরপতনের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহার।'

তিনি বলেন, ভালো ব্যাংকগুলো এখন আমানতের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশের ওপরে সুদের হার দিচ্ছে, অন্যদিকে ট্রেজারি রেটও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর প্রভাবে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে গেছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের শুরুতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে পোশাক খাতের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে পোশাক ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে। যখন কোন উৎপাদনমুখী খাতে উৎপাদন ব্যাহত হয় তখন তা শেষ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তার মতে, অত্যন্ত সংবেদনশীল এই বাজারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছুটা তাড়াহুড়োও করেছে। এটি আগে থেকে আস্থা সংকটে থাকা বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমিয়েছে। যার প্রভাবেও শেয়ারবাজারের পতন হচ্ছে।

'নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিল ধীরে ধীরে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা,' বলেন তিনি।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ২৭টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে নামিয়ে আনার আগে তাদের সঙ্গে সংলাপ করা উচিত ছিল।

তার ভাষ্য, 'এ ধরনের আলোচনা হলে কিছু কোম্পানি ডিভিডেন্ট প্রদান করতে পারতো। তাদেরকে আর জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর দরকার পড়তো না। যেহেতু এগুলো গত জুলাই মাস থেকে এ অবস্থায় ছিল, আরেকটু সময় নিয়ে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠালে বাজারের জন্য ভালো হতো।

আশিকুর রহমান জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী সুশাসন ও সামগ্রিক শেয়ারবাজারের ইকোসিস্টেমে বড় ধরনের উন্নতির আশায় কম দামে ব্লু-চিপ শেয়ার কিনেছিলেন।

এদিকে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সম্প্রতি পুঁজিবাজারের সূচক কমার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে ট্রিগার সেল বা মার্জিন লোনের বিপরীতে কেনা শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি।'

অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনার জন্য ব্রোকার-ডিলারের কাছ থেকে অর্থ ধার করে, পরে শেয়ারের দাম কমে গেলে ব্রোকার বা মার্চেন্ট তা ফোর্সড সেল কলে হলেও ঋণের টাকাকে রক্ষা করে।

কিন্তু ২০১১ সালে যখন শেয়ারের বড় দরপতন শুরু হয় তখন বিএসইসির পক্ষ থেকে ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকারদেরকে শেয়ার বিক্রি করতে দেওয়া হয়নি। ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া ঋণ একসময় ঋণাত্মক (নেগেটিভ ইক্যুইটি) হয়ে পড়ে। 

যাইহোক, তারা এখন শেয়ার বিক্রি করে লোকসান হলেও যতটুকু সম্ভব টাকা তুলে নিচ্ছে। তারা আশঙ্কা করছে, আগে এসব নেগেটিভ ইক্যুইটিতে প্রভিশন মওকুফ করা হলেও এখন থেকে তা করতে দেওয়া হবে না।

সাইফুল ইসলাম বলেন, ব্রোকারদের জোরপূর্বক বিক্রি কার্যকর করতে বাধা দেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি বিনিয়োগকারী ও ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংক সবার জন্যই ক্ষতি। এর বড় উদাহরণ হলো—২০১১ সালে যদি তাদেরকে ফোর্সড সেল করতে দেওয়া হতো, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের লোকসানে পড়েতো না, আবার বিনিয়োগকারীরাও কিছু টাকা হলেও ফেরত পেতেন।

কিন্তু তা বিক্রি করতে না দেওয়ায়, এখন প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকছে, আবার বিনিয়োগকারীরা এখনও ঋণী হয়ে রয়েছেন এসব কোম্পানির কাছে।

২০২৩ সাল শেষে দেশের পুঁজিবাজারে মার্জিন ঋণের বিপরীতে বকেয়া ঋণাত্মক ইক্যুইটি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকসহ প্রায় ৮৭টি প্রতিষ্ঠান এই বোঝা বহন করছে।

প্রবিধান অনুযায়ী, বাজারে ঋণাত্মক ইক্যুইটি হওয়া উচিত ছিল না, কারণ ঋণদাতাদের বাজার মূল্য ঋণের পরিমাণের নীচে নেমে যাওয়ার আগে মার্জিন অ্যাকাউন্টের সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য ছিল। তবে ২০২০ ও ২০১১ সালে বাজার ধসের পর মার্জিন অ্যাকাউন্টের সম্পদ বিক্রি থেকে বিরত থাকতে ঋণদাতাদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এই ভুল নির্দেশনার ফলে শেষ পর্যন্ত ঋণাত্মক ইক্যুইটি হয়, যা প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকায় নেমে আসে।

ফলে স্টক মার্কেট সূচক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ মধ্যস্থতাকারীরা এখন বাজারে পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে পারছেন না। সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্রমাগত লোকসানের কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তারা বিনিয়োগ তুলে না নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কারণ তারা বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা রেখেছেন যে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

তার ভাষ্য, বাজারে আরও বেশি স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একইসঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে হবে।

এদিকে ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, আগস্টের শুরু থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

তাই সম্প্রতি ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম কমানোকে 'অযৌক্তিক' বলে মনে করেন তিনি।

'আমার মতে, বর্তমান পরিস্থিতি দুই মাস আগের চেয়ে খারাপ নয়, তাই আমি ভালো কোম্পানি কমার কোনো জোরালো কারণ দেখছি না' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, তালিকাভুক্ত প্রায় ৫০ শতাংশ কোম্পানির খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল না। এরা তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং তাদের শেয়ারের দামও এতদিন বেশি ছিল।

ফলে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমা স্বাভাবিক, এর প্রভাবও রয়েছে শেয়ার বাজারের সূচক কমার ক্ষেত্রে।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago