বাংলাদেশে অস্থিরতার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর পোশাক রপ্তানি বেড়েছে
আগস্টের শুরুতে শ্রমিক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, চীন ও কম্বোডিয়ার রপ্তানি বেড়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেপ্টেম্বরে ভারতের তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ভারতের পোশাক রপ্তানির এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা এই খাতের অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুধীর শেখরি বলেন, 'বৈশ্বিক প্রতিকূলতা ও মূল্যস্ফীতির চাপ সত্ত্বেও ভারতের তৈরি পোশাক রপ্তানির রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ মন্দার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে ভারত লাভবান হয়েছে।'
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে কিছু কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। ফলে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
ভারতের কেয়াররেটিংয়ের কথা উল্লেখ করে দ্য টেলিগ্রাফ আরও বলেছে, যদি এক বা দুই প্রান্তিকের বেশি এই অস্থিরতা অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না।
অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ কমে ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
রপ্তানি কমার জন্য ওটেক্সা মার্কিন বাজারে পোশাকের চাহিদা কমাকে দায়ী করেছে।
ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস পণ্য মিলিয়ে রপ্তানি ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ কমে ৪ দশমিক ৮৪ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে ভালো করেছে। কারণ তথ্যে দেখা গেছে, তাদের রপ্তানির পরিমাণের দিক দিয়ে বেড়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলো এসব বাজারে পোশাক পণ্যসহ খুচরা পণ্যগুলোতে ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছে, বিশেষ করে মার্কিন বাজারে।
বিশ্বের বৃহত্তম খুচরা বাণিজ্য সংগঠন ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের (এনআরএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ জ্যাক ক্লেইনহেঞ্জ বলেন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার কমায় সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বিক্রি আবার বেড়েছে।
জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির পরিমাণ বার্ষিক ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে, অন্যদিকে পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
এ সময়ে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিজিএমইএ সংকলিত ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভারতের ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার বেড়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
একইভাবে বিজিএমইএ সংকলিত ইউরোস্ট্যাট তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-জুলাই সময়ে ইইউভুক্ত দেশগুলোর পোশাক আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশ থেকে বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
এ সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের পোশাক রপ্তানি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, কম্বোডিয়ার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সবমিলিয়ে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যেখানে ভিয়েতনামের ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও ভারতের ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজনৈতিক ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে বাংলাদেশের চেয়ে অন্যান্য দেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা নির্বিঘ্নে উৎপাদন ও সময়মতো শিপমেন্ট করতে পারছে না।
তারা বলেছেন, তৈরি পোশাকের কিছু বিদেশি ক্রেতা কারখানা পরিদর্শন স্থগিত করেছে। আবার কিছু ক্রেতা অর্ডার অন্য দেশে সরিয়ে নিয়েছে।
চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা চালু ও বন্ধের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেকের মতো তাদের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, 'তবে এখন আমি ক্রেতার কাছ থেকে প্রচুর ওয়ার্ক অর্ডার পাচ্ছি। পরের মৌসুমের জন্য তারা আবার ফিরতে শুরু করেছে।'
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামও এ কে আজাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, 'তৈরি পোশাক খাতের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় ক্রেতারা এখন ফিরতে শুরু করেছেন।'
Comments