প্রতিষ্ঠানগুলোর ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা
২০২৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের শেয়ারের দাম এক বছরের মধ্যে ৬০ টাকা থেকে ৩২০ টাকায় উঠেছিল। তখন গুঞ্জন উঠে—একটি বিদেশি বিনিয়োগকারী এই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনবে। তাতেই এর দাম বাড়ে।
অদ্ভুতভাবে, সেই গুঞ্জন 'সঠিক' প্রমাণিত হয়েছিল।
সেই বছর অক্টোবরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায়, এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার কেনার জন্য জেম গ্লোবাল ইল্ডকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মজার বিষয় হলো—মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশের পর শেয়ারের দাম বাড়ার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম অনেক কমে যায়।
গত কয়েক বছরে গুঞ্জনের ভিত্তিতে শেয়ারের দাম বহুগুণ বেড়ে যাওয়া সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এটিও সাধারণ বিষয় যে যখন পিএসআই প্রকাশের মাধ্যমে গুঞ্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়, তখন শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের পরিচালক সাইফুল ইসলামের মতে, পিএসআই প্রকাশের আগে যদি কোনো শেয়ারের দাম তিনগুণ বেড়ে যায়, এর অর্থ হচ্ছে এখানে ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে।
যখন প্রতিষ্ঠানের ভেতরের কেউ আগে থেকে কোন তথ্য জেনে যান, এবং তিনি শেয়ার কেনাবেচায় লাভবান হন, তাকে ইনসাইডার ট্রেডিং বলে। সিকিউরিটিজ আইনে এটি নিষিদ্ধ।
সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা এ ধরনের শেয়ার কেনাবেচা করছেন তারা পিএসআই সম্পর্কে জানেন। শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্য তা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়ে লাভবান হয়েছেন।'
'ফলে পিএসআই আসার পর তারা শেয়ার বিক্রি করে দেন, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তখন শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ওপর যদি এই পিএসআই বাস্তবায়ন না হয় তখন বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সি পার্লের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই ঘটেছে।'
তথ্য প্রকাশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির কাজ এখনো কার্যকর হয়নি। এরই মধ্যে সি পার্লের শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ৩৩ টাকায়।
সি পার্লের ঘটনাটি পিএসআই প্রকাশের পর তা বাস্তবায়ন না করার একমাত্র উদাহরণ নয়। এমন ঘটনা আরও অনেক আছে। বিডি ফাইন্যান্স ও দেশবন্ধু পলিমারও একই ধরনের কাজ করেছে।
যেমন, দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেডের কথাই ধরা যাক।
পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বিদেশে সুকুক বন্ড ইস্যু করে ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের ঘোষণা দেয়।
ঘোষণার আগে ছয় মাসের মধ্যে এর শেয়ারের দাম ১৭৮ শতাংশ বেড়ে ২৭ টাকা হয়। এরপর, এই প্রতিষ্ঠানটিও বিদেশি বিনিয়োগকারী পেয়েছে কিনা তা এখন পর্যন্ত পিএসআই দিয়ে জানায়নি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ১৬ টাকায়।
ডিএসই ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পিএসআই দিয়েও তা বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব পরিকল্পনার বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছু বলেনি।
একই কৌশল নেয় সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা দেয় যে একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান তাদের স্পন্সরদের শেয়ার কিনবে। চার মাসের মধ্যে শেয়ারের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১৩ টাকা ছয় পয়সা থেকে ৩৬ টাকা এক পয়সা হয়।
পরে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তি সই না করার ঘোষণা দেওয়ার পর শেয়ারের দাম আবার কমে যায়। আকস্মিক এই ইউটার্নের ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়লেও কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শেয়ার সাড়ে আট টাকা দরে লেনদেন হচ্ছে।
সাইফুল ইসলামের ভাষ্য, 'মূল্য-সংবেদনশীল প্রকাশে দেওয়া তথ্য ব্যবসায়িক কারণেও কখনো কখনো বাস্তবায়ন করা নাও হতে পারে। এটি বারবার ঘটলে ইঙ্গিত দেয় যে এটি কারসাজির অংশ হিসাবে বানোয়াট ছিল।'
পিএসআই প্রকাশ ও এর জোরদার বাস্তবায়নের জন্য ডিএসই ও বিএসইসির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, 'এটি সাধারণ মনিটরিং ইস্যু ছাড়া আর কিছুই নয়।'
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার কথা প্রকাশের পর সাধারণত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বেড়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক সময় প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের তথ্য প্রকাশ্যে আনে। তবে ব্যবসায়িক কারণেও চুক্তি ভেস্তে যেতে পারে।'
ঘোষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা যাচাই করে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে তা করা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পরামর্শও দেন তিনি।
বিষয়টি খতিয়ে দেখা ও বিনিয়োগকারীদের তা জানানো বিএসইসির দায়িত্ব।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও সহিদুল্লাহ সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ আনোয়ার হোসেনের মতে, 'পরিচালকরা অনেক সময় শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্য ডিসক্লোজার দিয়ে থাকেন।'
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের পরিচালকরা তখন তাদের অন্য কারো নামে শেয়ার কেনাবেচা করেন।'
তিনি বিএসইসিকে ডিসক্লোজার-সম্পর্কিত নিয়ম পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাষ্য, যখন কোনো চুক্তি হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে থাকে তখন কেবল প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ধরনের ডিসক্লোজার প্রকাশের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। কেননা, ডিসক্লোজার বাস্তবায়ন না হলে বিনিয়োগকারীরা তখন এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন।
তিনি আরও বলেন, 'পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত প্রমাণ সাপেক্ষে দোষী প্রমাণিত হলে পরিচালকদের কঠোর শাস্তি দেওয়া।'
শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, 'দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া এ ধরনের কাজ বন্ধ হবে না।'
তালিকাভুক্ত এক শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি সেক্রেটারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হলে প্রতিষ্ঠানগুলো আইনগতভাবে ডিসক্লোজার ইস্যু করতে বাধ্য নয়।'
'তবে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের জানাতে হবে বলে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সুশাসন ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন।'
নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পিএসআই বাস্তবায়ন করুক বা না করুক, তাদের অবশ্যই হালনাগাদ তথ্য দিতে হবে। তারা নানাভাবে তা করতে পারে। যেমন আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা জানাতে পারে।
ওই কর্মকর্তা সরকারকে এখানে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'যদি কোনো প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় তবে তাদেরকে আরও একটি ডিসক্লোজার প্রকাশ করতে হবে।'
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিগগিরই ডিসক্লোজারের মাধ্যমে আপডেট না দিলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।'
তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারির দায়িত্বও স্টক এক্সচেঞ্জের। যারা ডিসক্লোজারে উপস্থাপিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে না তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বলতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ।
ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাত্ত্বিক আহমেদ শাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর্মীর অভাবে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষে এসব তদারকি করা কঠিন।'
তবে, সব ঘটনাই ভুয়া না।
যেমন, ২০২১ সালে বিডি ফাইন্যান্স ঘোষণা করেছিল যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌম অবকাঠামো গ্রুপের (এসআইজি) সঙ্গে দুই বছরে অবকাঠামো প্রকল্পে দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আনতে চুক্তি করেছে।
ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম দ্বিগুণ বেড়ে ৬৯ টাকা হয়।
তিন বছর পরও বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রতিষ্ঠাটির শেয়ার এখন ১১ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. কায়সার হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটি চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানে বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চেয়ারম্যান অনানুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি সংবাদপত্রকে সেই তথ্য দিয়েছিলেন।'
'চেয়ারম্যান আমাকে বলেছিলেন যে এটি পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই তিনি গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করেছিলেন।'
এরপর হঠাৎ করে এ খবর কেন গণমাধ্যমে এসেছে তা জানতে কোম্পানিকে নোটিশ পাঠায় ডিএসই।
জবাবে প্রতিষ্ঠানটি ডিএসইকে সমঝোতা স্মারকের বিস্তারিত পাঠায়। পরে পিএসআই ঘোষণার অংশ হিসেবে তা প্রকাশ করা হয়।
কেন এই চুক্তি ভেস্তে গেল তাও ব্যাখ্যা করেন তিনি।
তার ভাষ্য, 'আমরা যখন সমঝোতা স্মারক সই করি, তখন নির্ধারিত হয়েছিল যে এই হার হবে সুরক্ষিত ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) এবং চার শতাংশ। সে সময় এসওএফআর ছিল শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ।'
'পরে এসওএফআর পাঁচ শতাংশে উন্নীত হয়। তাই ঋণ নিলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমরা ঋণ নেওয়া থেকে বিরত থেকে ইক্যুইটি আকারে ফান্ড পাওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে ইক্যুইটি আকারে তহবিল পাওয়া খুব চ্যালেঞ্জিং।'
এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার দেশবন্ধুর কোম্পানি সচিব লিয়াকত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন কল, ইমেইল ও মেসেজের জবাব দেননি।
সি পার্ল বিচ রিসোর্টের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আজহারুল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবো না।'
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল হক শামীমের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক যোগাযোগের সাত দিন কেটে গেলেও তিনি বার্তার জবাব দেননি।
Comments