জুলাই অভ্যুত্থানে আহত কবি ও লেখকদের গল্প
জুলাইয়ের ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে যখন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে লাশের ছবি, সামাজিক মাধ্যমে নির্মমতার বর্ণনা, সেসময়ও বন্দুকের সামনে ছাত্র-জনতা। আল মাহমুদের কবিতার মতো 'আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্ত কালের দিকে'। ছাত্রশিক্ষক থেকে পথচারী-রিকশাচালক, সাংবাদিক থেকে কবি লেখক, সবার ঐক্যে দেশজুড়ে বাংলাদেশের নবজাগরণ। যার পেছনে রয়েছে স্বৈরাচারের ভয়ঙ্কর নিপীড়নের অধ্যায়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বুকের ভিতর দারুণ ঝড় নিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন নজরুলের উত্তরাধিকার, বেঁচে গেছেন কেউ কেউ। এর মাঝে শিল্পী, আইনজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটা অংশ মাঠে নামলেও কবি লেখকদের অবস্থান ছিল হাতেগোনা। কিন্তু তারুণ্যের চোখেমুখে ছিল কবিতা গান শ্লোগান। নিজেরা নিজেদের দ্রোহের ভাব ভাষা দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দিয়েছেন। এর ছায়ায় আমরা খুঁজেছি এমন কিছু লেখককে, যারা আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, হয়েছেন শারীরিকভাবে আহত। অগ্রজরা যখন পদ ঠিক রাখতে ব্যস্ত, সে সময় তারুণ্য করেছেন কারাবরণ, কারো বেঁচে ফেরাই ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা। গাঁয়ে কাঁটা দেয়া সেই আহত ১৭ জন কবি ও লেখকদের গল্প নিয়ে আয়োজন।
হাসান আফিফ কবি (জন্ম, ২০০৭ ময়মনসিংহ)
বয়সে তরুণতর হাসান আফিফ। মা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হয় আফতাবনগরে। তার বড়চাচা সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করায় ১৩ জুলাই গ্রেফতার হয়। চাচার সঙ্গে থাকায় এই বয়সেও মামলা হয়। গ্রেফতার এড়াতে তাকে দাদাবাড়ি ময়মনসিংহ পাঠিয়ে দেয় পরিবার। সেখানে গিয়েও আন্দোলনে যুক্ত হন।
সে প্রসঙ্গে আফিফ জানান, ১৮ জুলাই সকাল ১১টায় বের হই। ময়মনসিংহ তেমন আলোড়ন না হওয়ায় আমার ক্ষোভ ছিল। তাই সরাসরি সিটি কর্পোরেশন রওনা হই বন্ধু জুবায়েরকে নিয়ে। বাকৃবি এক বড়ভাইকে কল করলে কিছু লোক পাঠায়। তাদের নিয়ে জড়ো হই। পুলিশ বাধা দিলে পুলিশের গাড়ির কাঁচ ভাঙা শুরু করি। তারা টিয়ারসেল মারে। তারপর গুলির আওয়াজ। আমার চোখ জলছিলো। ভয়ে কালেমা পড়ছিলাম। হঠাৎ পায়ে কয়েকটা গুলি লাগে। রক্ত বের হলেও টের পেলাম না। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে এলাম। রাতে দেখি মেডিক্যালে। পাশে আম্মু আর নানাভাই। আমায় বাসায় নিয়ে যাবে। কারন অনেক জায়গায় আহতদের নামে মামলা হয়েছে। ফলে কিছুদিন স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম।
আফিফ সামাজিক মাধ্যমে নিয়মিত কবিতা প্রকাশ করেন। ২০২৫ মেলায় কবিতার প্রথম বই আসবে।
শাহ হুজাইফা ফেরদৌস লেখক (জন্ম ২০০৬, হবিগঞ্জ)
সাঈদের মৃত্যুর ঘটনার পর ১৭ জুলাই রাজপথে নামেন শাহ হুজাইফা ফেরদৌস। সাইন্সল্যাবে হুজাইফা ও তার বন্ধু মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। সেসময় ছাত্রলীগের একটি দল তাদের গতি রোধ করে এবং মোবাইল ফোন দেখতে চায়। হুজাইফা মোবাইল ফোন ছাত্রলীগের হাতে দিতে অস্বীকৃতি জানালে বাঁশ ও লাঠি দিয়ে তাকে পেটানো হয়।
মারার এক পর্যায়ে তাকে দৌঁড় দিয়ে পালাতে বলে। বাঁচার জন্য হুজাইফা দৌঁড় দিলে পেছন থেকে ছাত্রলীগের কর্মীরা 'শিবির শিবির' বলে ধাওয়া দেয়। শাহবাগের একটি ফুডকোর্টের সামনে রাস্তায় বসে পড়েন। পেছন থেকে আসা আরও কিছু ছাত্রলীগ কর্মী আবারও আক্রমণ করে। এলোপাথাড়ি আঘাতে তাকে রক্তাক্ত করে। নিপীড়নের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগান দিতে বলেন। বেধড়ক মারের শিকার ঠিকমতো শ্লোগান দিতে না পারায় আবারও চড়-ঘুষি মারে।
সেসময় রাস্তার পাশে তাকে নিপীড়ন হতে দেখা একজন সিএনজি চালক তাকে তুলে লালবাগের ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যান। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতে মিরপুরের আরেকটি হাসপাতালে যান। ভয়াবহ এই হামলায় পায়ের নিচের অংশ থেতলে যায়। পরবর্তীতে পুলিশের 'ব্লক রেইড'র কারণে রাতে ভয়ে থাকতেন। সেসময় পুলিশ ঘরে ঢুকে শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে আন্দোলনকারীদের ধরে নিয়ে যেত। ভয়ে ভয়ে প্রতি রাত কাটতো। পত্রিকার পাশাপাশি ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন শাহ হুজাইফা।
হাসান ইনাম লেখক (জন্ম ২০০৩, সাতক্ষীরা)
৪ জুলাই আন্দোলনে অংশ নেন হাসান ইনাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথমদিন থেকেই ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচিতে সক্রিয় অবস্থান ছিল। ১৫ জুলাই ভিসি চত্বরে ছাত্রলীগের নির্মমভাবে হামলার শিকার হন ইনাম।
সেদিন সকালে টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে হলগুলোর দিকে যাওয়ার সময় রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনে বাধার শিকার হন। মিছিলের সামনে ছাত্রীরা। আক্রমণের আভাস পেয়ে ছাত্রীদেরকে বাঁচাতে সামনে এগিয়ে ইনামরা। সেসময় হেলমেট পরে লাঠিসোটা নিয়ে সূর্যসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মীদের মুখোমুখি হন তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু। ছাত্রলীগ পিছু হটতে বাধ্য হয়।
শৈশব থেকেই অ্যাজমার সমস্যা থাকায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয় হাসান ইনামের, রাস্তার উপর বসে পড়েন তিনি। সেসময় আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ চালায় ছাত্রলীগ। এতে ছাত্রলীগের সরাসরি নিপীড়নের শিকার হন তিনি।
কিন্তু আশেপাশে তার কিছু বন্ধু আরও বেশি আহত হয়েছেন। নিজের কথা ভুলে আরও দু'জনকে রিক্সায় নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসেন। সেসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের আক্রমণের ভয় ছিল। তাই বন্ধুদের চিকিৎসার সময় বাইরে অপেক্ষা করছিলেন ইনাম। কিছুক্ষণ আগের হামলা ও অ্যাজমা মিলে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন ইনাম, তখন বন্ধুদের চিকিৎসা দিতে আসা ইনামকেই নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় গণমাধ্যমে।
আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করে 'ব্লক রেইড' দিয়ে উঠিয়ে নিতে শুরু করলে অসুস্থ অবস্থাতে আত্মগোপনে চলে যান ইনাম। সরকার পতনের পর জাতীয় পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে অংশ নেন। যদিও তখন তার শরীরে ছিল আক্রমণের ঘা।
উপন্যাস ও নন-ফিকশনসহ হাসান ইনামের ৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
মাসুক নুর কবি (জন্ম ২০০৩, সুনামগঞ্জ)
ছাত্র আন্দোলনের 'বাংলা ব্লকেড' সময় থেকে ৭ জুলাই অংশ নেন মাসুক নুর। তখন থেকে প্রায় নিয়মিত শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচিতে থাকতেন তিনি। সেসময় রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করার মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।
শুধুমাত্র অংশগ্রহণ নয়; বরং আন্দোলনের খবর জানাতে কাজ করেছেন তিনি। খবর সংগ্রহ ও লেখালেখির জন্য উত্তরা থেকে রামপুরা, মহাখালী, মিরপুর এমনকি যাত্রাবাড়ীও যান তিনি। ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়ার পর কফিন কাঁধে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হন মাসুক নুর। একদিকে ছাত্রলীগের হামলা অপরদিকে পুলিশের টিয়ারশেলে অসুস্থ হয়ে যান। যদিও আগুনের তাপ নিয়ে প্রাথমিক সুস্থ হন। পরে আনসার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে আবারও আহত হন তিনি। মাসুক নুরের মাথায় ১১টি সেলাই দেয়া হয়। 'সুখের সাথে হয় না দেখা' নামে মাসুক নুরের বই প্রকাশিত হয়েছে।
সাবরিনা শশী কবি (জন্ম ২০০১, বরিশাল)
বরিশালের বাসিন্দা সাবরিনা শশী একটি কাজে এসে আটকে যান ঢাকায়। অপেক্ষা করছিলেন আন্দোলন কমলে যাবেন কিন্তু তার মাঝে দূরপাল্লার বাস বন্ধ হয়ে যায়। বরিশাল যাবার সম্ভাবনা কমতে শুরু করে।
শশী আন্দোলনে অংশ নেন ১৮ জুলাই। ঢাকায় পরিচিত কেউ না থাকায়, একেকদিন একেক স্থানের আন্দোলনে যোগ দিতেন। ধানমন্ডি-২৭ থেকে সাইন্সল্যাব হয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার কিংবা প্রেসক্লাবের মতো জায়গাতেও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে অংশ নেয়ার প্রথম দিনই ১৮ জুলাই আহত হন তিনি। ধানমন্ডি-২৭ এ মুখোমুখি সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যান শশী।
ইট-পাটকেল ও রাবার বুলেটে শশীকে আহত করে। শশী বলেন, 'আমাদের দিকে প্রবল বেগে প্যালেট, রাবার বুলেট, টিয়ারগ্যাস ছোড়া হচ্ছিল, মাঝেমধ্যে গুলি বর্ষণও হচ্ছিল। অনেকেই আমার চোখের সামনে আহত হয়েছে। নিজেও হয়েছি কিন্তু চোখের সামনে এত এত ছোট বড় ভাইবোনদের এরূপ হতাহত অবস্থা দেখে নিজের ক্ষতগুলোকে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।
কিছু রাবার বুলেট শরীরে ছিল কিন্তু জেদ ধরেছিলাম এই স্বৈরশাসকের পতন নিশ্চিত না করে শরীর থেকে বের করবো না। কিন্তু যেহেতু শ্বাসকষ্টের রোগী, তার উপর আন্দোলনে চশমা হারিয়ে চোখের দশাও করুন এমতাবস্থায় রাবার বুলেট, প্যালেটের থেকেও টিয়ারগ্যাস কষ্ট দিয়েছিল'।
সাবরিনা শশীর 'চৈত্র শেষে' শিরোনামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
শেরিফ ফারুকী লেখক, (জন্ম ২০০১, চট্টগ্রাম)
তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার স্লোগান দিয়ে যে রাতে মেয়েরা হলের গেইট ভেঙ্গে বেরিয়ে এলে, সে রাতে শেরিফ ফারুকী যে বেরিয়ে আসেন, তারপর বাসায় গেছেন ৫ আগস্ট রাতে। এরমধ্যে নিরাপদ বোধ না করায় কখনো বড় ভাইয়ের বাসায় কখনো বন্ধুদের বাসায় ছিলেন। তিনি বেশির ভাগ সময় সাইন্সল্যাব, মিরপুর, শাহবাগ-টিএসসি ও শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী এলাকার আন্দোলনে ছিলেন।
আক্রমণের প্রসঙ্গে বলেন- ১৭ জুলাই শহীদদের গায়েবানা জানাজার জন্য বাসা থেকে বের হই। জানাজা শেষ হলে পুলিশ এবং বিজিবি অ্যাকশনে যায়। চারপাশে অবরুদ্ধ ঢাবির হলপাড়ায় থাকা ছেলেরা বেরুতে পারছিলো না। যারা বের হচ্ছিলো নীলক্ষেত, টিএসসি ও ফুলার রোড দিয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছিলো। সন্ধ্যায় কাঁটাবন দিয়ে এগোচ্ছিলাম। আজিজ সুপারমার্কেটের অপজিটে একটা গেইট আছে ঢাবির। যেটা তেমন কারো চোখে পড়ে না। ওখান দিয়ে একটা ছেলে দুই হাতে ব্যাগ নিয়ে বের হলো। মার্কেটের পাশের অন্ধকার গলি থেকে ছাত্রলীগের এককর্মী রড দিয়ে পেটাতে শুরু করে। হামলাকারী একজন দেখে বাঁধা দিলাম। ছেলেটা অবাকই হলো। ঢাবির ওই ছাত্রকে ছেড়ে আমার কলার ধরলো। গলি থেকে বেরিয়ে আসলো আরও অন্তত ৮-১০ জন। রাস্তায় ফেলেই আমাকে পেটাতে থাকলো। ঘাড়ে, পিঠে পায়ে কোথাও বাকি রইলো না। একপর্যায় টেনেহিঁচড়ে পাশের গলিতে নিয়ে গেল। রাস্তায় আমাকে আরেকদফা। কোনো রকমে দৌড়ে আসি।
কদিন বের হতে পারিনি। তারপর সরকার পতনের পর প্রায় পাগলের মতো চিৎকার করেছি। মনে হয়েছে দমবদ্ধ একটা পরিস্থিতির মাত্র শেষ হলো। আনন্দে ভাতটাও খাইনি। তবে বাঁ কান, বাম হাতের আঙ্গুল ও পায়ে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এখনো চিকিৎসা চলছে।
শেরিফ ফারুকীর ২টি সায়েন্স ফিকশন বই বেরিয়েছে। মেলায় আসবে অভ্যুত্থানের দিনলিপি 'জুলাই ডায়েরি' নামে।
হাসনাত আবদুল্লাহ লেখক (জন্ম ২০০১, কুমিল্লা)
হাসনাত আবদুল্লাহ আন্দোলনের প্রথমদিন থেকেই যুক্ত ছিল। প্রথমে শাহবাগে, পরবর্তীতে একটা কাজে বাড়িতে গিয়ে আটকে যায় সে। বাড়িতেই থেকেই আন্দোলন চালিয়েছে। ১৮ তারিখের পর থেকে পুলিশি নজরদারির কারণে আর বাড়িতে থাকতে পারেনি।
কিন্তু আহত হয়েছে আগস্টের ৪ তারিখ। তারপর পাশের উপজেলা দেবীদ্বারে আত্মগোপনে চলে যায়। সেখানে আবার আন্দোলনে যুক্ত হয়। সেখানে একপর্যায়ে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ হামলা চালায়। হকিস্টিকের আঘাতে সে নিচে পড়ে যায়, এরপর কয়েকজন লাঠিয়াল মিলে তাকেসহ আরও কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। তার ডান পায়ের গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার হয়েছিল, পরবর্তীতে ১০-১৫ দিন বিছানায় থাকতে হয়।
কাদের মাজহার লেখক, (জন্ম ২০০১, লক্ষ্মীপুর)
শুরুতে আড়ালে থেকে সংহতি প্রকাশ করলেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনার বিরূপ মন্তব্যের পর সরাসরি আন্দোলনে অংশ নেন কাদের মাজহার। সাইন্সল্যাব থেকে আজিমপুর এলাকা ছিল আন্দোলনের স্থান। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডে আহত হন।
১৮ জুলাই আবার আন্দোলনে অংশ নিলে সন্ধ্যায় আজিমপুর থেকে কাদেরকে আটক করে পুলিশ। ৩ দিন আটকে রাখে। ২১ জুলাই আদালতে ওঠানো হয় তাকে এবং কারাগারে পাঠায়। প্রায় ১৩ দিন পর ২ আগস্ট জামিনে এসে আবারও আন্দোলনে যোগ দেন। তার দাবি, পরদিন ৩ আগস্ট লালবাগ থেকে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে আসার সময় পুলিশ তাকে ক্রসফায়ারের হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু ৩ আগস্টে ১ দফা দাবি ঘোষণা করার পর আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।
১টি কাব্যগ্রন্থসহ কাদের মাজহারের মোট ৩টি বই প্রকাশ হয়েছে।
ইব্রাহিম নিরব কবি (জন্ম ২০০১, মুন্সিগঞ্জ)
ইব্রাহিম নিরব ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। নিরব শুধু নিপীড়নের স্বীকার হয়েছেন তাই নয়; বরং তার মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়েছিল। হাসপাতালের একটি বিছানায় শুয়ে দুর্বল দেহের অসুস্থ নিরবের একটি ভিডিও ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে, যেখানে তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্দীপনা তৈরি করেছিলেন।
শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে অংশ নিয়েছিলেন ২ জুলাইতে। আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ (বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা) নিরবকে আন্দোলনে অংশ নিতে ব্যক্তিগতভাবে আহবান জানান। শাহবাগের মূলমঞ্চ থেকে নেতৃত্ব দিলেও বাংলা ব্লকেড শুরু হলে চাঁনখারপুল মোড়ে একাই দৃঢ় অবস্থান রাখেন। এছাড়াও টিএসসি, গুলিস্তান, আজিমপুর এলাকাতেও পুরো আন্দোলনের সময় সক্রিয় ছিলেন।
১৮ জুলাই আন্দোলনে যাবার উদ্দেশ্যে রিক্সায় আজিমপুর এলাকায় বাধার মুখে পড়েন নিরব। সেখানে আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের পরিচয়ে ৫০-৬০ জনের একটি দল মুঠোফোন চেক করে। সেখানেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন। রিক্সা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে লাঠিসোটা দিয়ে আঘাত করে। প্রতিহত করলে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে, এতে শার্ট ছিঁড়ে যায়। মাথা ফেটে যায়। নিপীড়নকারীদের কেউ কেউ ইব্রাহিম নিরবের বিশেষ অঙ্গে আঘাত করে। এরপর 'জঙ্গী' বলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
পুলিশের ভ্যানে ওঠার পর নীরব পানি খেতে চাইলে পানি দিতে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। থানায় প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আটকে রাখার পর নীরবকে নিম্ন আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। পরিবারকে খবর জানানোর জন্য অনুরোধ করলে ঘুষ চায় পুলিশ। ওষুধ, খাওয়া চাওয়া, স্বজনহীন অন্ধকারে কাটিয়েছেন সে সময়। ৫ আগস্ট কারাগারের মধ্যেই শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা জানতে পারেন। প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করতে পারেননি। 'কারাগারের ভেতর অনেক গুজব ছড়াচ্ছিল। যদিও বাহিরের দুনিয়ার সাথে আমরা পুরো বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আসর ও মাগরিবের নামাজে বড় মুনাজাত করছিলাম, যেন কথাটা সত্যি হয়', বলছিলেন ইব্রাহিম নীরব।
কারাগারের বাইরে ঢাকার রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। তখন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম নীরবকে অনতিবিলম্বে মুক্তির দাবি জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেসময় অসুস্থ হয়ে কারা মেডিকেলে ভর্তি হতে হয় নীরবকে। এ কারণে কারাগারের অধ্যায় আরও দীর্ঘ হয়। এখনও সেই নিপীড়নের কারণে তৈরি হওয়া শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
'দ্য বাস্টার্ড উন্নয়ন' নামে নীরবের একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এটির জন্যও ছাত্রলীগ কর্তৃক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন।
তুহিন খান অনুবাদক, (জন্ম ১৯৯৫, বরিশাল)
তুহিন খান জুলাই আন্দোলনের প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে কোনো ন্যায্য আন্দোলনে, আলাপে তাকে দেখা যায়। তবে তার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটেছিল শহিদ মিনারে, ৪ আগস্ট রাত ৯ টার দিকে। তিনি দেখেন শহিদ মিনারে দুটি লাশ পড়ে আছে। তার কয়েকজন বন্ধু, আশপাশের দুই একজন, রিকশাচালক ও অন্যান্যদের সহায়তায় লাশ দুটি ঢামেকে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মেডিকেলের দিক থেকে পুলিশ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে। এসময় দৌড় দিতেই পায়ে ছররা গুলি লাগে, তাৎক্ষনিক ব্যথা অনুভব হয়নি। বাসায় গেলে বাকিটা বুঝা যায়। পরের দিন সরকার পতনের খবর শুনে রাস্তায় বসে পড়ে কেঁদে দিয়েছেন তুহিন। এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য আর অবাস্তব মনে হয়েছে।
তুহিনের প্রকাশিত সবকটি (৫) বই-ই অনুবাদের। এরমধ্যে আল মুহাদ্দিসাত, গায়েবি শহর, আমাদের সংগীত।
আল নাহিয়ান লেখক (জন্ম ১৯৯১, বরিশাল)
লেখালেখির পাশাপাশি ইচ্ছে ছিল সাংবাদিকতার। তার সেই স্বপ্ন আর নেই। আওয়ামী সরকারের সময় তরুণ লেখকদের মধ্যে যারা দীর্ঘমেয়াদী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, আল নাহিয়ান তাদেরই একজন।
২০১৩ সালে গণজাগরণের সময়ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেসময় যেই সাহিত্য পত্রিকায় কাজ করতেন তিনি, তার সম্পাদকসহ সবাইকে তুলে নেয়। বিচারবহির্ভূতভাবে আটক রাখে ৮ দিন। ২০২৩ সালে আবারও আক্রমণের শিকার হন তিনি। স্থানীয় কিশোর গ্যাং মারে। সেসময় তার হাতে ১০টি ও নাকে প্রায় ৪টি সেলাই লেগেছিল। এই ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে উল্টো ভুক্তভোগী আল নাহিয়ানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা দেয় পুলিশ।
কোর্টের হাজিরা, অনবরত পুলিশের নজরদারি ও টানা নিপীড়নে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত নাহিয়ান জুলাই অভ্যুত্থানে স্বশরীরে অংশ নেন আগস্টের প্রথম দিকে। হামলার শিকার হন ৫ আগস্ট বিকালে। তিনি দেখতে পান, শ্যামলী খেলার মাঠের সামনে গোলাগুলি চলছে। ছাত্র-জনতার বিপরীতে ২৫-৩০ জন পুলিশ অনবরত গুলি করছিল। দূর থেকে পুলিশকে গুলি না করার অনুরোধ করছিল জনতা। নাহিয়ানের গায়ে বাংলাদেশের পতাকা চিহ্নিত টিশার্ট ছিল। এই টিশার্টটি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে ভেবে নাহিয়ান আরও এগিয়ে যান এবং নিচু হয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গী করেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিলেও আবারও সংঘর্ষ শুরু এবং পুলিশ নাহিয়ানের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
আল নাহিয়ানের চোখের নিচের অংশ ঘেঁসে একটি গুলি বালুর বস্তার গায়ে লাগে এবং বস্তাটি বিস্ফোরিত হয়। চেহারায় গুলি লাগার পর বাম পায়ে আরও কিছু ছোড়া গুলি লাগে। আল নাহিয়ান ছাড়াও সেসময় অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। সঙ্গে থাকা তার কাজিন সেই জায়গাতেই নিহত হন। আহতদের সঙ্গে আল নাহিয়াছকে ধরাধরি করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু তারা গুলির চিকিৎসা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। তখন তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হয়। বর্তমানে বাসা-হাসপাতাল মিলে চিকিৎসা চলছে। আল নাহিয়ানের ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির বাইরেও অভিনয় ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ কথাসাহিত্যিক (জন্ম ১৯৯১, পাবনা)
আসাদুল্লাহ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ১৬ জুলাই। মিরপুর-১০ থেকে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ছিল তার অংশগ্রহণের জায়গা। ১৮ জুলাই টিয়ারশেল বিস্ফোরণে আহত হন। দৌঁড়াদৌড়ির মাঝে জ্ঞান হারান। এরপর শারীরিকভাবে আর আহত না হলেও সরকার পতনের দিন আন্দোলন প্রতিহতকারীদের নিপীড়নের শিকার হন। 'মিরপুর-২ পূর্ণিমা হোটেলের পিছে স্টেডিয়ামের ২ নং গেটের সামনে পুলিশের জেরায় পড়েন। পুলিশ প্রেসকার্ড চেক করছিল, বাকবিতণ্ডা চলছিল, এমন সময় পেছন থেকে আন্দোলন প্রতিহতকারী একজন ডান বাহুতে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়।
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহর ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ৩টি উপন্যাস, ৩টি গল্পগ্রন্থ।
মোরশেদ আলম হৃদয় লেখক (জন্ম ১৯৯০, কুমিল্লা)
১৫ জুলাই থেকে সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিলেন। কেবল লেখালেখি করেই সামাজিক দায় মিটে না বলে মাঠে নেমেছিলেন মোরশেদ। তার মা বলতেন- 'তোর আল্লার দোহাই, বাহির অইস না। ঘরে থাক, অবস্থা বালা না' মায়ের কথা রাখতে পারেননি তিনি। মানুষের রক্ত দেখে ঘরে থাকা অসম্ভব ছিল। মাঠে থাকলে ছাত্ররা প্রেরণা পাবেন। শুধু তাই নয়- বন্ধুদের থেকে চাঁদা তুলে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পানি বিস্কুট কলা বিতরণ করেছেন।
তিনি জানান, '২১ জুলাই কাজলা থেকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। ফেসবুকেও সরব ছিলাম। নিজের মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে অসংখ্য লাশ ও গুলিবিদ্ধ মানুষকে নিজের হাতে টেনে নিয়েছি। এমন কাজে পুলিশের নজরদারিতে শুরু থেকেই আমি। ডিবি অফিসে ১৮ দিন ছিলাম। হাত-পা দুটিতে নির্মমভাবে আঘাত করে। হাতটি এখনো ভাঙ্গা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হওয়ায় জোড়া লাগেনি হাড়। সে সময় এতো অসহায় লেগেছিলো বলার ভাষা নেই। জানতে পারছি না দেশের কি হচ্ছে, কিভাবে মারছে, যাদের সাথে থেকে আন্দোলন করতে তারা কতজন বেঁচে আছে? স্বৈরাচার খুনি এখনো আছে? এই ভাবনায় দিন পার করতাম।
৫ আগস্ট সম্ভবত দুপুর ১টায় এক কারারক্ষী দৌড়ে এসে খবর জানালো হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আমাদের চিৎকারে পুরো কারাগার কেঁপে উঠেছে, কান্না করতে করতে সবাই নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। অথচ আমাদের মনে হয়নি বাঁচতে পারবো, মনে হতো যে কোনো সময়ই মরে যেতে হবে। বোনাস জীবন আমাদের'।
হৃদয়ের 'ভালোবাসাহীন পৃথিবী','একমুঠো সুখ'সহ ১১টি বই।
চঞ্চল বাশার কবি (১৯৮৭, কিশোরগঞ্জ)
২০১৩ সাল থেকেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেছিলেন চঞ্চল বাশার। এবারে যুক্ত হয়েছিলেন ১৭ জুলাই। সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা তাকে প্রচন্ডভাবে তাড়িত করে। তাই ১৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার একরামপুরে ছাত্র-জনতার জমায়েতে অংশ নেন। সারাদিন শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচী পালন করলেও একসময় পুলিশ চড়াও হয়।
২০ জুলাই কারফিউ ভেঙ্গে কটিয়াদী ঢাকা-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করেন চঞ্চল বাশাররা। সেসময় আওয়ামী সমর্থিত কিছু মানুষ তাদের উপর আক্রমণ করতে এলে প্রতিহত করেন তারা। ৪ আগস্ট কিশোরগঞ্জের একরামপুরে অবস্থান নিলে পুলিশের সাথে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা গুলি করে। এতে চঞ্চল বাশারসহ অনেকে আহত হন। আন্দোলনে পানি বিতরণ করতে আসা ইকবাল নামের একজন শহিদ হন। সেদিন আন্দোলন করতে আসা অনেকে আহত হন। এদের বেশিরভাগ এখনও চিকিৎসাধীন। ক'দিন আগে তাদের সঙ্গী একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বলে জানান।
চঞ্চল বাশারের কাব্যগন্থ 'স্বেদে ও শোণিতে'।
আকতার জামান কবি (১৯৮০, নরসিংদী)
আকতার জামান, পেশায় শিক্ষক। লেখালেখি করেছেন ছোটবেলা থেকে। কিন্তু মানুষের কষ্ট দেখলে খারাপ লাগে। সামাজিক সঙ্কটে মাঠে নামেন। সে চেতনায় অস্থির ১৮ জুলাই খবর পান তার ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ছুটে যান নরসিংদী সদর হাসপাতালে চলে যান। খবর দেন তার পরিবারকে। এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা পাঠান। একজন যথাযথ শিক্ষক ও অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। এমন মানুষের প্রেরণায় আমরা মুক্তি পেয়েছি।
প্রসঙ্গে বলেন, 'জেলখানার মোড়ে আমি ও আমার কলিগ মহসিন সিকদার জেলখানার মোড়ে আন্দোলনে অংশ নিই। তারপর ১৮ জুলাই রাতে নরসিংদী পৌরপার্কে বসে আমি, কবি এমরানুর রেজা, মহসিন সিকদার ও সাদেক মুকুল ভাই সিদ্ধান্ত নিই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমরা একটি ভাজপত্র করবো। যে কথা সেই কাজ। ১৯ জুলাই 'নামের বাইরে' শিরোনামে একটি ভাজপত্র বের করি আমরা। যেটি আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের সাহস ও উৎসাহ দিতে বিতরণ করি। এরপর প্রতিদিনই আমি, মহসিন সিকদার, এস এ মিলন, সজিব, মাইনুদ্দিন-- আমরা মাঠে ছিলাম।
ছাত্রদের মাঝে পানি বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেই। মনে পড়ে- ৪ আগস্ট নরসিংদী পৌরপার্ক থেকে ২০০-২৫০ জন শিক্ষক প্লেকার্ড, ব্যানার হাতে মিছিল বের করি এবং নরসিংদী সরকারি কলেজের সামনে অবস্থান নিই। আমাদের মধ্যে অনেকেই বক্তৃতা করি। বক্তৃতাটি ফেসবুকে লাইভ প্রচারিত হয়। বহু মানুষের কাছে চলে যায়। এসপি অফিস আমাদের ৪৬জন শিক্ষকের তালিকা করে এবং ৪ আগস্ট রাতে আমাদের ৪ জন শিক্ষককে এসপি তার অফিসে ডেকে নিয়ে যান এবং আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন। প্রায় ৪০ মিনিট আলাপ শেষে আমরা এসপি অফিস থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু আমরা তেমন কিছু তাদের বলিনি'।
জামান তিনি আরও বলেন- 'যদি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে না যেত, এই বিজয় না আসতো আমরা জেলের ভেতর থাকতাম। যাইহোক, আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় আসে। জেলখানার মোড় থেকে বিজয় মিছিল নিয়ে আমরা যখন এসপি অফিসের সামনে দিয়ে আসছিলাম, তখনই এসপি অফিস থেকে আচমকা গুলিবর্ষণ, আমি ও আমার সহকর্মী সজিব গুলিবিদ্ধ হই এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আহত অবস্থায় উঠে দৌঁড় দেই। হাসপাতালে পাঁচটি গুলির মধ্যে তিনটি গুলি বের করতে সক্ষম হই। এখনও দুটি গুলি শরীরে রয়ে গেছে'।
তার ৩টি কবিতার বই। নাতিশীতোষ্ণ এ অঞ্চলে অনেক কিছুই ঘটে, বৃষ্টিমাখা চা ও তোমার বুকে জুঁইফুলের বাগান।
হানিফ মোল্লা, লেখক (জন্ম ১৯৮৩, কুমিল্লা)
হানিফ মোল্লা জুলাই আন্দোলনে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। এই নিয়ে লেখালেখিও করেছেন। ফলে ২২ জুলাই রাত সাড়ে ৩টায় প্রচণ্ড জোরে দরোজা পেটার শব্দ পান তিনি। খুবই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন কে? লুকিং গ্লাসে দেখেন সিভিল পোষাকে আট-দশজন।
প্রসঙ্গে মোল্লা বলেন- কেয়ার টেকারের অনুরোধে দরোজা খুললে তারা বলে -চলেন আমাদের সাথে। জিজ্ঞেস করলাম কেন? বললো আপনার মোবাইল নিয়ে আসুন। তাদের কাছে নাকি আমার সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধী স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট আছে। তখনো আমার ঘোর কাটেনি। নীচে নেমে দেখলাম কালো রঙের তিনটি মাইক্রোবাসে সদস্যরা এসেছে আমাকে নিতে। যেন আমি কোন ভয়ানক অপরাধী।
বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এমন আরও নির্মম ঘটনা আছে, যা হয়তো আমাদের জানা নেই। অনেক অচেনা অজানা ঘটনার পরেই এসেছে আমাদের বিজয়-মুক্তি। সে মুক্তি ধরে রাখতে হবে সম্মিলিতভাবে। স্মরণ করতে হবে না জানা আহত নিহত সাথীদেরও।
বারবার পাসওয়ার্ড জিজ্ঞেস করছিলো। আমাদের উপর তলার ফ্লাটের এক পুলিশ ভাইকে মিলি ততোক্ষণে ডেকে আনলো। উনি এসেই ঘটনা আরও জটিল করলেন। তার পরিচিত একজন ও সেই টিমের সদস্য ছিলেন। বলতে হয় আমার ভাগ্য ভালো! হয়তো আমাকেও গুম করে দিতো। এ ধারণা হবার কারণ আমার থানার কেউ তখনো জানতো না যে আমাকে গ্রেফতার করা হবে। ফজর পর্যন্ত আমাকে হালিশহর থানায় বসিয়ে রাখে। কর্তব্যরত ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে আমার লকাপ নিশ্চিত করে চলে গেলো। দুপুরে থানা থেকে পাঁচলাইশ থানায় চালান করে দেয়। সেখান থেকে মামলা দিয়ে পাঠায় আদালতের কাস্টোডিতে। কোর্ট ছাড়াই পাঠিয়ে দেয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাবাসের অমানবিক ১৫ দিনের অভিজ্ঞতা!
জামিন পেয়েছি হাসিনার পালানোর পরের দিন। সেই ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এখনো! এ এক অস্বাভাবিক জীবন যাপন। আমার অপরাধ ছিলো আন্দোলন নিয়ে ফেসবুক পোস্ট। স্বৈরাচারকেকে স্বৈরাচার বলা। হাসিনার পতন না হলে আমি ও পরিবারের জীবনকে তছনছ করে দিতো। কারাগারে এমন অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ পেয়েছি। তার দুটি গল্পের বই 'কাফনবিহীন ও 'বেনী আসহকলা'।
সালেহ আহমদ খসরু কবি (জন্ম ১৯৬০, সিলেট)
'সিলেট যেখানে দল-মতের ওপরে থাকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। সেই সিলেটের সম্প্রীতি পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয় ফ্যাসিবাদের থাবা। তাই মোক্ষম সময়ে জ্বলে উঠে তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা এবং এর ফসল উঠতে শুরু হয় ২০ জুলাইয়ের পর থেকে। ৩০ জুলাই নিজের অন্তর বলে দেয়, আর কদিন পরেই বিদায় নিচ্ছে ফ্যাসিবাদের বাংলা ড্রাকুলা।
৩১, ৩২ ও ৩৩ জুলাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সুবিদবাজার, আম্বরখানা, দরগাহগেট, চৌহাট্টা, মীরবক্সটুলা, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার নগরের মূল অঞ্চল হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এক কেল্লা। ৩৬ জুলাই আমি ড্রাকুলার সম্ভবত শেষ গুলিতে আক্রান্ত হই, সেদিন হাত থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে, সঙ্গে আকাশ হতে বরিষণ। সহযোদ্ধা খালেদসহ পাড়ি দিই উঁচু প্রাচীর, তারপর ফয়সাল ফার্মেসির ফয়সাল ভাই এসে উইমেনস মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা শেষে বাসায় পৌঁছে দেন। ততক্ষণে দেশ মুক্ত বিহঙ্গের মতো মেলেছে ডানা'।
বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এমন আরও নির্মম ঘটনা আছে, যা হয়তো আমাদের জানা নেই। অনেক অচেনা অজানা ঘটনার পরেই এসেছে আমাদের বিজয়-মুক্তি। সে মুক্তি ধরে রাখতে হবে সম্মিলিতভাবে। স্মরণ করতে হবে না জানা আহত নিহত সাথীদেরও।
মনে রাখতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতিতে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল স্বৈরাচারী শাসক। কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, কেন এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল—এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের সময় এসেছে। কবি লেখকদের লিখতে হবে মন খুলে। ভুলতে পারি না হাত হারানো আতিকুল, চোখ হারানো শতশত বিদ্রোহী- প্রত্যাকের গল্প একটা উপন্যাসের ক্যানভাস। তাদের কথা লিখতে হবে কবিদের।
Comments