ভারত-চীনের সাহায্যে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে: আলী রীয়াজ

আলী রীয়াজ | ছবি: টেলিভিশন থেকে নেওয়া

ভারত এবং চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে ফ্যাসিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে ১৫ বছর এই ফ্যাসিস্ট রেজিমটা টিকে ছিল বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে। জাতীয় স্বার্থ বিক্রি করে দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য।'

ঢাকা কলেজ মিলনায়তনে শনিবার কালের ধ্বনি নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা আয়োজিত 'গণ-অভ্যুত্থানে আহত কবি ও লেখকদের গল্প' শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এই কথা বলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড এই অধ্যাপক বলেন, ফ্যাসিবাদ ফেরত আসবে কি আসবে না সেই আশঙ্কায় আমরা আছি। সঠিকভাবেই আছি, ফেরত আসতে পারে কিন্তু সেটা মোকাবিলার উপায় হচ্ছে, যে চারটি বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ১৫ বছর ফ্যাসিজম টিকেছে, সেই পিলারগুলো চিহ্নিত করতে পারছেন কি না, সেই পিলারগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া যাচ্ছে কি না।

তিনি বলেন, বিদেশি শক্তি ভারত এবং চীন। ভারতের যেমন প্রত্যক্ষ একটা ব্যাপারে ছিল, চীনের প্রত্যক্ষ নয়—এক ধরনের সমর্থন। দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে না পারলে, গণমাধ্যমগুলো দায়িত্বশীল, প্রকৃত গণমাধ্যমের ভূমিকা পালনের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে, বিপরীত সংস্কৃতি দাঁড় করাতে না পারলে কেবল প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে ফ্যাসিবাদ ঠেকানো যাবে না।

প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান বদলাতেই হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না। আমার মত হচ্ছে, যে চারটা পিলার দিয়ে টিকে ছিল; যদি ভবিষ্যতে না আনতে চাই, তাহলে ওই চারটা মোকাবিলা করি। জাতীয়তাবাদী হতে হবে, জাতীয় স্বার্থকে সামনে রাখতে হবে। সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান তৈরি করতে হবে, যেটা বিকল্প উপহার দেয়। গণমাধ্যমকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেন ওই ভূমিকা পালন করে যেটা অন্ততপক্ষে মিথ্যাচার ও ব্যক্তিপূজা না হয়। এগুলো আমরা যতক্ষণ না উপলব্ধি করছি, এই সংগ্রাম যতক্ষণ না হচ্ছে, আমাদের এই আশঙ্কার মধ্যেই থাকতে হবে। আন্দোলন হয়, পরিবর্তন হয় না কারণ এই জায়গাগুলো আমরা এতদিন অ্যাড্রেস করতে পারিনি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেই সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন চারটি খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ছিল বল প্রয়োগের ওপর এবং সেটার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় পিলার হলো, এক ধরনের আদর্শিক আধিপত্য তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে কখনো বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যদিও তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়—বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হয়েছে, উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কথা বলা হয়েছে, ইতিহাসের একটা বিশেষ ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে।

এখানে এসে যেটা হয়েছে, যেটা পূর্ববর্তী ৩৫ বছরের ইতিহাসে সফল হয়নি, বাংলাদেশের কথিত বুদ্ধিজীবীরা তাদের আত্মা বিক্রি করে দাসত্বকে মেনে নিয়েছেন। সেই দাসত্বকে তাদের অর্জন বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন,' যোগ করেন তিনি।

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, তৃতীয় পিলারটি হলো গণমাধ্যমগুলো গণমাধ্যমের চরিত্র অনুসারে কাজ করতে পারেনি এবং চতুর্থ পিলারটি হলো, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে, বিদেশের প্রভাব ব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। এ ক্ষেত্রে সরাসরি ভারত ও প্রচ্ছন্নভাবে চীনের প্রভাব কাজ করেছে।

১৭জন আহত কবি ও লেখকদের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত করেছে কালের ধ্বনি। অনুষ্ঠানে এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে আহত হওয়া কবি, লেখকদের আন্দোলনের দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন। এই পর্বে বিভিন্ন বয়সের ১৫জন লেখক ও কবি তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ছোট বইও প্রকাশিত করেছে কালের ধ্বনি। অনুষ্ঠানে এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। পরে ছিল অভ্যুত্থান–পরবর্তী পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা।

আয়োজনে অতিথি বক্তা শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, সংবিধান করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার যে মূলনীতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, ৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধান তা জনগণকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আলোচনায় আরও অংশ নেন মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কাজল রশীদ শাহীন, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, আমিরুল মোমেনীন। অতিথি বক্তা হিসেবে আরও ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী, চিকিৎসক সাকিরা পারভিন, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটশিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজ।

অভ্যুত্থানে আহত কবি ও লেখকদের মধ্যে অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন হাসান আফিফ, শাহ হুজাইফা ফেরদৌস, হাসান ইমাম, মাসুক নুর, শেরিফ ফারুকী, হাসনাত আবদুল্লাহ, কাদের মাজহার, ইব্রাহিম নিরব, তুহিন খান, আল নাহিয়ান, মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ, মোরশেদ আলম, চঞ্চল বাশার, আক্তার জামান, হানিফ মোল্লা ও সালেহ আহমদ। সংগীত পরিবেশন করেন রিয়াজুল ইসলাম ও পার্শা মাহজাবিন। সঞ্চালনা করেন কালের ধ্বনির সম্পাদক কবি ইমরান মাহফুজ ও লেখক জুবায়ের ইবনে কামাল।

Comments

The Daily Star  | English
crimes against journalists

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

17h ago