নদীভাঙনে দিশেহারা মানুষ, পাশে চাই অন্তর্বর্তী সরকার ও সর্বস্তরের সবাইকে

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রংপুর অঞ্চল বৈষম্যের তলানিতে পড়ে আছে। এ অঞ্চলের দারিদ্র্যতিলক দূর করতে হলে অবশ্যই এ এলাকার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ অঞ্চলের বন্যা ও ভাঙন দূর করতে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের চর খিতাব খাঁ গ্রামটির একটি অংশ এখন তিস্তা নদীর বুকে। ২০২১ সাল যখন সেখানে ভাঙন তীব্র হয়, তখনই যদি তা রোধ করা যেত, তাহলে দৈর্ঘ্যে সাড়ে চার কিলোমিটার ও প্রস্থে আড়াই কিলোমিটার অংশ নদীতে বিলীন হতো না। 

যে অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে তার মোটামুটি আর্থিক ক্ষতির ধারণা পাওয়া যায়। জমি, বাড়ি, বাগান, পুকুরসহ হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। 

মাত্র ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করলে সেখানকার ভাঙন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হতো। এখনো সেখানে নদী ভাঙছে এবং কবে এ ভাঙন বন্ধ হবে তা অনিশ্চিত। এতে যে আরও হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে না, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। 

ভাঙনকবলিত স্থান থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ছোট নদী কোটেশ্বর। উজান থেকে আসা ছোট নদীতে আছে একটি স্লুইসগেট। স্থানীয়দের আশঙ্কা, ভাঙতে ভাঙতে তিস্তা নদী এ পর্যন্ত এসে পড়লে অনেক জনপদের ক্ষতি হবে। তবে, এসব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।

সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে কথা হয় ৭০ বছর বয়সী আব্দুল খালেকের সঙ্গে। বছর দুয়েক আগে তার ঘর তিস্তায় বিলীন হয়। পাকা ওই ঘরে ১২টি কক্ষ ছিল। এরপর নদীর পাশে অন্যের জায়গায় একটি টিনের ঘর তোলেন তিনি। একটি ঘরে স্ত্রী, মেয়ে, ছেলে, ছেলের বউ সবাই থাকেন। ঘরের ভেতরে লম্বা কাপড় দিয়ে পার্টিশন তৈরি করেন। 

এ বছর আবারও নদী ঘরের কাছে চলে এসেছে। ঘরে যে কয়টা সামান্য জিনিসপত্র আছে তা রাখার জায়গা পাচ্ছেন না বৃদ্ধ খালেক। বাড়ি ভেঙে গেলে কোথায় থাকবেন জানেন না। 

আব্দুল খালেক টলমল চোখে নিজের জীবনের কথা বলছিলেন। জানালেন, সরকারিভাবে জমি কিংবা ঘর কিছুই পাননি। তার পাশেই বসেছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য শহীদুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, 'হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হইছে এই গতিয়াশামে। সরকার একজনকেও একটা ঘর দেয় নাই। জমি দেয় নাই।' 

যেখানে বসে কথা বলছিলাম তার পাশেই ছোট্ট একটি টিনের চালা। সেটি মূলত রান্নাঘর। ওই রান্নাঘরে একটি পরিবার বাস করছে। স্থানীয়দের কাছে জানলাম, ওই এলাকার ভোটার ছিলেন ৩ হাজার ৮০০ জন। নদী ভাঙনের পর এখন ভোটার মাত্র ৮০০। সেখানে বাড়ি ছিল ১ হাজার ৭৫টি। তার মধ্যে ৮০০ বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন। অনেক পাকা সড়ক, মসজিদ, স্কুলসহ অনেক স্থাপনাই এখন নদীগর্ভে। 

এমন অবস্থা তিস্তাপাড়ের কেবল একটি স্থানে। এখানে ভাঙনপ্রবণ এলাকা প্রায় ৩২ কিলোমিটার। ভাঙন রোধে সরকার সবসময় দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে।

সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যা। এ বন্যায় মানুষ মারা গেছেন ৬৯ জন। এর ক্ষতিপূরণ হবে না। সরকারের পাশাপাশি সারাদেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ এই বন্যায় যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের সবাই একদিনের বেতন দিয়েছে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পূর্বাঞ্চলীয় বন্যায় সহায়তাকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রংপুর অঞ্চলের মানুষেরা একটি প্রশ্ন তুলেছেন। রংপুর অঞ্চলের জেলাগুলোতে যখন প্রচণ্ড বন্যা হয়, ভাঙন হয় তখন কি সারাদেশের মানুষ এভাবে পাশে দাঁড়ায়? কিংবা এর একশ ভাগের একভাগও কি পাশে দাঁড়ায়? এখন যে ভয়াবহ ভাঙন চলছে এগুলোর কি কোনো আলাপ আছে কোথাও?

রংপুর অঞ্চলের বন্যায় একেবারেই মানুষ পাশে দাঁড়ায় না এ কথা বললে ভুল হবে। ২০১৭ সালে বন্যার্তদের পাশে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিল। এরপর কমতে কমতে এখন আর তেমন কেউ দাঁড়ায় না। 

এ অঞ্চলের বন্যার খবরগুলো গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচার করা হয়, সেখানেও বৈষম্য আছে। টেলিভিশনে হলে অধিকাংশ সময় দেখা যায় বিকেলের গ্রাম জনপদের খবরে, আর পত্রিকায় হলে উত্তরাঞ্চল কিংবা রংপুর সংস্করণে। ফলে কাগজের খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না। অধিকাংশ গণমাধ্যম আগের সরকারের মুখপাত্র হওয়ার কারণে বন্যার্তদের সহায়তা না দেওয়ার খবরগুলো তেমন প্রচার করা হতো না। 

কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী জেলার ভাঙন রোধে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা মনে করি। সাধারণ মানুষও এই ভাঙন রোধে অংশ নিতে পারে। যে মানুষগুলো বাড়িঘর হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে, তাদের জমি কিনে দেওয়া যেতে পারে। যে স্থানগুলোতে ভাঙছে সেগুলোতে নিজেদের তদারকিতে জিও ব্যাগ ফেলে সাময়িক ভাঙন ঠেকানো সম্ভব। শুষ্ক মৌসুমে ব্লক দিয়ে ভাঙন রোধ করা সম্ভব। যেমন, উল্লিখিত চর খিতাব খাঁ এলাকা তিস্তার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এই মুহূর্তে ১৫-২০ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই অল্প টাকায় ওই গ্রামের প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো উদ্যোগে এই টাকা পাওয়া গেলে ওই স্থানে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে। 

শুধু এখানকার ভাঙন নয়, সব ভাঙন রোধ করতে হবে। আগুনে পুড়ে গেলে জমি থাকে। বন্যায় ক্ষতি হলেও কিছু রয়ে যায়। কিন্তু, নদী ভাঙনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। ভাঙনে অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা পরিমাপ করা গেলেও, মানবিক পর্যায়ে যে ক্ষতি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারও বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানের কবর বিলীন হচ্ছে। মানুষের স্মৃতিময় ঠিকানা হারিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন কত স্বজন-বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দেয় তার ইয়ত্তা নেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রংপুর অঞ্চল বৈষম্যের তলানিতে পড়ে আছে। এ অঞ্চলের দারিদ্র্যতিলক দূর করতে হলে অবশ্যই এ এলাকার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ অঞ্চলের বন্যা ও ভাঙন দূর করতে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

wadudtuhin@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Post-August 5 politics: BNP, Jamaat drifting apart

The taunts and barbs leave little room for doubt that the 33-year-old ties have soured. Since the fall of Sheikh Hasina’s government on August 5, BNP and Jamaat-e-Islami leaders have differed in private and in public on various issues, including reforms and election timeframe.

6h ago