লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সময় এখনই

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট ১৫১ জন শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতির বলি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৪ জন
নিষ্ঠুর এক ঘটনার জেরে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় বুয়েটে, ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার রক্তে এক ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান ঘটে গেল। সেই অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন। সেদিন থেকে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন রাখছেন। যে ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের ভ্যানগার্ড থাকার পরিবর্তে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই রাজনীতির বৈধতা আছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠছে সবখানে।

একথা সত্য যে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্তি ছিনিয়ে আনতে অসামান্য অবদান রেখেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এই ছাত্র সংগঠনগুলো শুধুই পথ হারিয়েছে।তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব ভুলে দিনে দিনে জাতির বোঝায় পরিণত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি মানে ক্যাম্পাসে পেশিশক্তির মহড়া, ক্ষমতাসীনদের টিকিয়ে রাখতে জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্য করা, হলের ভয়ংকর গেস্ট-রুম প্রথার মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ভীতির পরিবেশ, ফাও খাওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সুবাদে অন্তত দুটি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেই স্মৃতিগুলো একদমই সুখকর ছিল না। ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের যেন একটা অবমাননাকর দাসত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। পরীক্ষার আগের রাতেও জোর করে গেস্ট-রুম করানো, গেস্ট-রুম, মিছিল-মিটিং এ যোগ না দিলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেওয়া, এমনকি নেতানেত্রীদের সালাম দিতে ভুলে গেলেও অকথ্য গালিগালাজ কিংবা চড়থাপ্পড় খাওয়া। আমিও একাধিকবার এমন সব নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।

সাধারণ ছাত্রদের গালে-মুখে শুধু চড়থাপ্পড় মেরেই ক্ষান্ত হতো না। মন চাইলে ক্যাম্পাসজুড়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠত। প্রায়ই দুই গ্রুপের মধ্যে হল দখলের রক্তক্ষয়ী লড়াই দেখা যেত। সেই লড়াইয়ে নেতাকর্মীদের হাতে দেখা যেত দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র যেমন: রামদা, চাপাতি, হাসুয়া, রড, হকিস্টিক। কারো কারো হাতে রিভলবার কিংবা পিস্তল পর্যন্ত দেখা যেত! সেসব সংঘর্ষে প্রায় অর্ধশত কিংবা তারও বেশি শিক্ষার্থী মারাত্মক আহত ও জখম হত। কেউ কেউ নির্মমভাবে মারাও পড়ত। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্যার এফ. রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে আবু বকর নামের এক ছাত্র নিহত হয়। সে সময় এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় সারা দেশের মানুষের চোখের পানি ফেলেছিল।

ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির বলি শুধু আবু বকর নয়। দেশের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আরো অনেক ঘটেছে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজি মোহাম্মদ মুহসিন হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত জন শিক্ষার্থী নির্মমভাবে খুনের শিকার হন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্তৃক আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এস.এম. হলে শিবির কর্মীদের হাতে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক। 

২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন জোবায়ের আহমেদ। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিশ্বজিৎ দাস। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলিতে রাব্বি নামে ১০ বছরের একজন শিশু খুন হয়। পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পরে এ পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট ১৫১ জন শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতির বলি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৪ জন (প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর, ২০১৯)

প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের রব উঠেছে। ২০১৯ সালে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মূলত দেশের নাগরিকগণ এ দাবিতে সোচ্চার। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এক জরিপে বুয়েটের ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে ভোট দেন

স্বাধীনতার পরে অন্যায়-অপকর্মে এদেশের ছাত্র রাজনীতির নাম যতটুকু জড়িয়ে আছে, ততটুকু সুনাম নেই কোনো ভালো কাজে। ছাত্র রাজনীতি এখন যেমন সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থের কথা বলে না, তেমনি দেশের সার্বিক উন্নয়নেও এর তেমন ভূমিকা নেই। শিক্ষাঙ্গনে সংঘটিত সাধারণ ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে ক্যাম্পাসগুলোতে প্রথম যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটি সংঘটিত হয়েছিল সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে। এখানে ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো ভূমিকা তো ছিলই না, উল্টো ছাত্রলীগ সেই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমন করার জন্য বারবার সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। 

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন করে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেখানেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন সাধারণ ছাত্রদের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারেনি। উল্টো তারা আবারও সাধারণ ছাত্রদের উপরে সশস্ত্র হামলা করে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস রক্তাক্ত করেছিল- যা পরবর্তীতে দেশের আপামর ছাত্র-জনতাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং প্রবল এক গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে।

এসব বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সচেতন মহলে প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের রব উঠেছে। ২০১৯ সালে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মূলত দেশের নাগরিকগণ এ দাবিতে সোচ্চার। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এক জরিপে বুয়েটের ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে ভোট দেন (ইনকিলাব, ৪ এপ্রিল ২০২৪)।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান তো দেশের মানুষের চোখে আর একবার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি এখন আর দেশের জন্য আশির্বাদ নয়, বরং তা অভিশাপ। বিশেষজ্ঞরা বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন দেশের প্রচলিত লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসের ছাত্র সংসদ সক্রিয় করতে- যাতে ছাত্ররা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়ে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে... 

শিক্ষক, পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা 

Comments

The Daily Star  | English

Post-August 5 politics: BNP, Jamaat drifting apart

The taunts and barbs leave little room for doubt that the 33-year-old ties have soured. Since the fall of Sheikh Hasina’s government on August 5, BNP and Jamaat-e-Islami leaders have differed in private and in public on various issues, including reforms and election timeframe.

7h ago