নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে বদলে গেছে প্রেক্ষাপট

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কেন এতগুলো মানুষ মারা গেল, সেটারও তদন্ত করতে হবে। ছবি: পলাশ খান/স্টার

প্রধানমন্ত্রী ও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বারবার বলছেন, কোটা সংস্কারের সব দাবি মেনে নেওয়া সত্ত্বেও কেন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এখনো চলছে? বারবার এমন প্রশ্ন প্রমাণ করছে যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতারা এতটাই জনবিচ্ছিন্ন যে সত্যটা জেনেও তারা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না। পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বিবেচনাহীন গুলিতে দুই শতাধিক নিহত ও হাজারো মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা যে সামগ্রিক পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে দিয়েছে, সেটা তারা অস্বীকার করছেন কিংবা ভুলে যেতে চাইছেন। এই ঘটনায় দেড়শ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি সরকারই স্বীকার করেছে।

সাম্প্রতিক সহিংসতায় চোখে আঘাত পেয়ে ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৪০০ জন, যাদের মধ্যে ৩০০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এবং আড়াইশ জনকে চোখের অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই এক বা উভয় চোখে ছররা গুলির (সাম্প্রতিক সহিংসতায় পুলিশের ব্যবহার করা গুলি) আঘাত পেয়েছেন। এ থেকে ধারণা করা যায় এরকম আহতের মোট সংখ্যা কত হতে পারে। গুলির আঘাতে কতজন মানুষ একটি বা উভয় হাত-পা হারাবেন, সেই সংখ্যা আমাদের জানা নেই। কতজনের অস্ত্রোপচার করাতে হবে, তাও আমরা জানি না। আহতদের মধ্যে কতজন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন?

এসব ঘটনা এমনই নির্বিচার সহিংসতার প্রতিচ্ছবি, যেগুলোকে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ দমনে পুলিশের প্রচলিত পদক্ষেপের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। এসব ঘটনা 'দেখামাত্র গুলি করার' চিন্তার প্রতিফলন, যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এক নেতা।

আজকের আলোচ্য বিষয় ন্যায়বিচার চাওয়া। সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের হত্যা, জনমানুষের বিরুদ্ধে পুলিশ ও বিজিবিকে ঘাতকের ভূমিকায় নিয়োজিত করা, অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার, 'ব্লক রেইড', বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি, মিথ্যা মামলা এবং বিক্ষোভকারীদের ঢালাওভাবে নাশকতা সৃষ্টিকারী ও রাষ্ট্রবিরোধী তকমা দিয়ে অপমান করার বিপরীতে ন্যায়বিচার।

যে বিষয়টি সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে এবং জনমনে ক্রোধ তৈরি করেছে, তা হলো এক ভীতিকর পরিবেশ, যার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী ও রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট মানুষ। (এক বাবা আমাকে ফোন করে বললেন, 'আমার ছেলে স্কুলে পড়ে। রাতে যখনই আমার বাড়ির কাছে কোনো গাড়ি থামার শব্দ পাই, তখনই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।')

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিঃসন্দেহে কোনো নাগরিক আন্দোলনের বিপরীতে সরকারের সবচেয়ে সহিংস প্রতিক্রিয়া। পুরো উপমহাদেশেও এমন নজির আছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। কীভাবে একটি বেসামরিক সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম হামলা চালাতে দিয়েছে, তা চিন্তা করে আমরা শিউরে উঠি। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ বেশ কয়েক দিন ধরেই এটি চলেছে। প্রথম, দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় দিনের মতো এমন ঘটনার শেষেও কি কোনো উপলব্ধি, চিন্তাধারার পরিবর্তন বা ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি? কেউ কি ভাবেনি যে নিজ দেশের মানুষের ওপর এই নির্মম ও ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের অবসান হওয়া উচিত?

যে দলটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, কী কারণে আজ তারা এই পর্যায়ে এসে পৌঁছাল? কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়া ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা, লোভ, বিপুল সম্পদ গড়ার প্রবণতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার মনোভাবই এর জন্য দায়ী।

এত এত মৃত্যুর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকার ছয় বছর বয়সী শিশু রিয়া গোপের মৃত্যুর ঘটনা। ১৯ জুলাই বিকেলে চারতলা বাড়ির ছাদে খেলছিল সে। ওই সময় তাদের বাড়ির কাছে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। তখন তার বাবা দীপক কুমার গোপ দৌড়ে ছাদে যান রিয়াকে আনতে। তিনি যখন মেয়েকে কোলে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরছিলেন, তখন হঠাৎ একটি গুলি এসে শিশুটির মাথায় লাগে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৫ জুলাই মৃত্যু হয় রিয়ার।

কীভাবে চারতলা ভবনের ছাদে থাকা কারো গায়ে গুলি লাগে, যদি না পুলিশ সেই ছাদ লক্ষ্য করে গুলি না ছুড়ে থাকে? রিয়া কি কারো জন্য হুমকি ছিল? হয়তো এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হবে। কিন্তু চারতলা ভবনের ছাদে বাবার কোলে থাকা এক শিশুর মৃত্যুর ক্ষেত্রে কি এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে?

এবার বিক্ষোভ দমনের ক্ষেত্রে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নতুন কৌশল দেখেছি। সেটা হলো—হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়া। সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, বিশেষ করে আলোকচিত্রীরা যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন, তা হলো—হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল। ১৮ ও ১৯ জুলাই সকালে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, শনির আখড়া, কাজলা ও সাইনবোর্ড এলাকায় হেলিকপ্টার মহড়া দিচ্ছিল। মহড়া চলাকালীন মাঝেমধ্যে সেগুলো নিচে নেমে আসে এবং সেখান থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। ওই হেলিকপ্টারগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোগো স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

নারায়ণগঞ্জের সুমাইয়া আক্তারের ঘটনাটি এই তথ্যকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। দুই মাস বয়সী শিশুর মা ছিলেন সুমাইয়া (২০)। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে এবং বাইরে সংঘর্ষ আঁচ করতে পেরে কী হচ্ছে তা দেখতে তিনি তার মায়ের পেছন পেছন ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় যান। সেই সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়। ছয়তলার ফ্ল্যাটে এই গুলিটি কোত্থেকে এসেছে? এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে হেলিকপ্টার থেকেই গুলিটি ছোড়া হয়েছে এবং তার পরিবারের সদস্যরাও এমনটিই জানিয়েছেন। হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালাতে দেখার যে দাবি আরও অনেকেই করেছেন, এই ঘটনায় তা আরও গ্রহণযোগ্যতা পায়।

কীভাবে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিজ দেশের সরকার হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালাতে পারে? যখন কোনো 'শত্রু' এলাকা বা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দখলে থাকা কোনো জায়গায় অভিযান চালানো হয়, শুধু তখনই হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর নজির রয়েছে। কীভাবে আমাদের বিজিবি, র‍্যাব বা পুলিশ নিজেদের মানুষের ওপর এভাবে গুলি চালাতে পারল?

আমরা এভাবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানাই। একদিকে যেমন সব মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় তদন্ত অব্যাহত থাকা উচিত, অন্যদিকে নির্দিষ্ট এই ঘটনার ক্ষেত্রেও আলাদা ও দ্রুত তদন্ত-বিচার হওয়া উচিত, যাতে সত্য উন্মোচিত হয়।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কেন এতগুলো মানুষ মারা গেল, সেটারও তদন্ত করতে হবে। গুলি চালানোর আগে কে, কীভাবে হুমকির বিষয়টি যাচাই করেছিল? কোন পর্যায়ে এসে তাদেরকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর অনুমতি দেওয়া হলো এবং কে এমন নির্বিচার গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন? গুলি করতে ব্যবহৃত রাইফেলগুলো ছিল অত্যাধুনিক। বিজিবির ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ছিল আমাদের সীমান্ত রক্ষার জন্য। কীভাবে সেই একই অস্ত্র দিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনের অনুমোদন পেল? বিক্ষোভকারীদের দমনে মাত্রাতিরিক্ত বল ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে কি না, তদন্তে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাউকেই অস্ত্র হাতে দেখা যায়নি। তাদের হাতে ছিল লাঠি ও লোহার রড।

সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এখনো তাদের নিজস্ব 'বুদবুদের' মাঝেই বসবাস করছে এবং শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে জনমনে যে গভীর বেদনার ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়টিকে তারা হালকাভাবে নিচ্ছে। আমরা ধারণা করছি, ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আগ পর্যন্ত ক্যাম্পাস ও সড়কে শান্তি ফিরে আসবে না। পরিস্থিতি 'শান্ত' করতে বলপ্রয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু এতে সাময়িক ফল পাওয়া যাবে। অনিশ্চয়তায় ঘেরা এই পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে দেশের অর্থনীতি, কমতে থাকবে আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা।

যারা সাধারণত ক্ষমতা প্রয়োগে কার্য সাধন করে থাকে, এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তারা ভাবে না। আমরা আনসার, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, এমনকি সেনাবাহিনীও মোতায়েন করতে দেখেছি। কারফিউ জারি করার মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপও নেওয়া হলো। তাতে ফলাফল কী হয়েছে? হ্যাঁ, সহিংসতা, মৃত্যু, গ্রেপ্তার ও হয়রানি আরও বাড়তে পারে। কিন্তু দিনশেষে জনমনে আরও ক্ষোভ, ঘৃণা ও হতাশা সৃষ্টি হবে। বল প্রয়োগে সাময়িক স্বস্তি আসতে পারে, স্থায়ী বা টেকসই স্বস্তি আসবে না। এতে প্রকৃত যে সমস্যা—'ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি এবং সীমাহীন ক্ষমতার মাধ্যমে সীমাহীন দুর্নীতি (লর্ড অ্যাক্টনের বাণী থেকে অনুপ্রাণিত)'—তার কোনো সমাধান হবে না।

প্রকৃত সত্যের বিপরীতে সরকার যেন কোনো সুবিধাজনক বর্ণনা আঁকড়ে ধরে না থাকে, আমরা সেই আহ্বান জানাই। বিক্ষোভকারীদের দমনে যে ধরনের সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, যেভাবে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত-আহত হয়েছেন, তার যথাযথ তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিতেরও আহ্বান জানাই। আমরা আরও আহ্বান জানাই, তারা যেন আরও বেশি বোকা না বনেন। কারণ আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সব তথ্যই মানুষের হাতে আছে। হ্যাঁ, ডিজিটাল মাধ্যমে অনেক মিথ্যা সংবাদ ও ভিডিও থাকতে পারে। কিন্তু অনেক গ্রহণযোগ্য ভিডিও ও সংবাদও আছে। সরকারের উচিত বাস্তব পরিস্থিতিকে পাশ কাটানোর চেষ্টা না করা। কারণ এতে শুধু তাদের বিপদই বাড়বে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments