ভুল থেকে শিক্ষা নেবো, নাকি বারবার ভুল করে যাব?

ক্ষমতাসীনরা যা বলে এবং জনগণ যা বিশ্বাস করে, তা এক নাও হতে পারে।
এই সময়কালের মূল্যায়ন যতটা জনগণের স্বার্থে হওয়া দরকার, ঠিক ততটাই দরকার ক্ষমতাসীন দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। ছবি: স্টার

কয়েকজন মন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী বিশেষ মতাদর্শ ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী কর্তৃক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম করে দেশকে অস্থিতিশীল করা, নানা কারণে বিক্ষুদ্ধ সাধারণ মানুষকে উসকে দিয়ে 'সরকার উৎখাতে'র চেষ্টা ছিল। তাদের দাবি সত্য হলে আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তার নিন্দা জানাই এবং এটা বুঝতে হবে যে উন্নয়ন ও সামগ্রিক অগ্রযাত্রা-বিরোধী অভ্যন্তরীণ শত্রুর মুখোমুখি আমাদের দেশ।

জনগণের সম্পদ ধ্বংস করা এবং সরকারি অফিস, গাড়ি, গণপরিবহন, ইন্টারনেট অবকাঠামোতে আগুন দেওয়া অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। এর মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য, উৎপাদন ও নাগরিকের দৈনন্দিন জীবন রুদ্ধ হয়ে যায়। এসব অপরাধীদের পরিচয় প্রকাশ এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া জরুরি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এসব কর্মকাণ্ড উদঘাটনে আমরা গণমাধ্যম সরকারকে সহায়তা করব। যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তাদের প্রতিহত ও পরাজিত করতে হবে।

সেইসঙ্গে আরও একটি বিষয় আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। আমরা প্রত্যক্ষ করছি, ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক ধরনের প্রচেষ্টা চলছে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে প্রচেষ্টা চলছে 'সত্য'কে প্রতিষ্ঠিত করার। শাসক দলের সুবিধাভোগীরাও এই চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে।

জর্জ অরওয়েল, আপনাকে বাংলাদেশে স্বাগতম। দুঃখিত, আপনি আগেও বহুবার এ দেশে এসেছেন।

শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের দাবির বিষয়টি ধীরে ধীরে সরকারি ভাষ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের কথা। আমাদের মতে, দুটি বিষয়ই আলোচনায় রাখা এবং গভীর বিশ্লেষণ করা দরকার। কিন্তু কেন একটি বিষয় চাপা পড়ে যাচ্ছে এবং অপরটিকে বড় করা হচ্ছে? কারণ, একটি ক্ষমতাসীনদের জন্য বিব্রতকর এবং অপরটি সুবিধাজনক। পরস্পর দোষারোপ করে একে অপরকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরার খেলা পুরোদমে চলছে। নতুন ন্যারেটিভ অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই ছিল নিছকই 'দাবার গুটি' এবং তাদের হাত থেকে আন্দোলন ছিনিয়ে নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার, এমনকি 'সরকার উৎখাত করা'র প্রচেষ্টা হয়েছে।

সবাইকে নাড়িয়ে দেওয়া ঘটনাগুলো আমরা বিশ্লেষণ না করার এবং ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার পুরোনো নীতিতে ফিরে যাচ্ছি। কীভাবে কয়েকদিনেই ১৫৪ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হলো, তাৎক্ষণিক কেন আমরা তার তদন্তে গুরুত্ব দিচ্ছি না? হয়তো কখনোই জানতে চাইব না যে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন কীভাবে সহিংস হয়ে গেল; সরকার কেন সংকট নিরসনে সময়মতো উদ্যোগ নেয়নি; শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের অন্তর্নিহিত কারণ কী; পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো ভুল হয়েছে কি না; এত মৃত্যু কেন; পুলিশ দায়িত্বশীল আচরণ করেছিল কি না; যখন তারা গুলি চালালো সেটা বাধ্য হয়েই চালালো কি না; গুলি চালাতে হলেও এতটা নৃশংস হওয়া দরকার ছিল কি না; 'রাজাকার' ইস্যুটি আদৌ সামনে আনার প্রয়োজন ছিল কি না; কেউ শিক্ষার্থীদের এই স্বাধীনতাবিরোধী স্লোগান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল কি না (যেটা তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে থামিয়ে দিয়েছিল); বিজিবি মোতায়েনের পরপরই গুলিতে নিহতের সংখ্যা এত বেশি কেন; বিজিবিকে কি ভুল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, নাকি তারা বিবেচনাহীনভাবে গুলি চালাচ্ছিল? ছাত্রলীগকে মোকাবিলা করতে না বলে দীর্ঘ ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কি শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে পারত না; 'দেখামাত্র গুলি করা' কি প্রয়োজন ছিল; পুলিশের গুলি কি পরিস্থিতির আরও অবনতি করেনি? এরকম আরও অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমেই দিতে হবে। তা না হলে আমরা কখনই ভুল থেকে শিক্ষা নেবো না এবং সেগুলো বারবার করতে থাকব।

এত রক্ত, এত বর্বরতা, কোটা সংস্কারের দাবি করা শিক্ষার্থীদের এমন নির্বিচারে মারধর, এত সুচিন্তিত তথ্য বিকৃতি, এত ঘুরানো-প্যাঁচানো কথা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের 'রাজাকার' বলে ভ্রান্ত 'তকমা' দেওয়া, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসারত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, বিক্ষোভকারীদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ এবং বর্তমানে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের ফলে যে গভীর সন্দেহ তৈরি হচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে সরকারের কোনো প্রস্তাব খুব সহজেই গৃহীত হবে, সেই আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। আগে শিক্ষার্থীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কাজটি কঠিন, কিন্তু আন্তরিক চেষ্টায় সেটা করতে হবে।

ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

সহজ কথায়, কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দুটি স্বতন্ত্র পর্ব রয়েছে। কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপন হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষণার মাধ্যমে ৫ জুন প্রথম পর্ব শুরু হয়ে চলে ১৯ জুলাই পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় সেই সময় থেকে যখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ব্যাপক প্রাণহানি শুরু হয়।

দুটি পর্বের মধ্যে পার্থক্য হলো সহিংসতা। প্রথম পর্বে কোনো সহিংসতা ছিল না এবং দুঃখজনকভাবে দ্বিতীয় পর্বে প্রচুর সহিংসতা হয়েছে। প্রথম পর্ব ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয় পর্ব ছিল অত্যন্ত সহিংস, যা চলাকালীন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়েছে—বিশেষ করে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সদস্যরা এতে জড়িত বলে দাবি করছে সরকার।

আমরা মনে করি, প্রথম পর্বটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা এবং দ্বিতীয় পর্বের দিকে সব মনোযোগ রাখার সরকারি প্রচেষ্টা জনসাধারণের প্রত্যাশার প্রতিফলন নয়। যদিও দ্বিতীয় পর্বের গভীর ষড়যন্ত্র উন্মোচনের প্রয়াস অত্যন্ত জোর দিয়ে চালিয়ে যেতে হবে। আমরা গণমাধ্যম এ বিষয়ে সহযোগিতা করব এবং প্রমাণভিত্তিক সবকিছুই প্রকাশ করব। তবে প্রথম পর্বে করা ভুলগুলো উপেক্ষা করা এবং এত মৃত্যু, আহত ও হামলার ঘটনা কীভাবে ঘটলো, তার তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের শাস্তি না দেওয়াটা হবে বিরাট ভুল।

আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন দাবি ছিল কেবল কোটা সংস্কার। সরকারের অদক্ষতা ও কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমনের চেষ্টায় এর সঙ্গে আরও অনেক দাবি যুক্ত হয়েছে। যখন পর্যন্ত একটি মৃত্যুও হয়নি, সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি, সারা দেশে হাজারো শিক্ষার্থী নিজ নিজ ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছিল, কোটা সংস্কারের জন্য আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছিল—ঠিক সেই সময়েই সরকারের উচিত ছিল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলা। এক্ষেত্রে সেটা হয়নি, বরং উল্টো হয়েছে।

দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ক্যাডার, পুলিশ ও সাধারণ জনগণসহ ১৫৪ জনের বেশি মানুষ নিহত—স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ—এবং তিন হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক মারধর করা হলো। শিক্ষার্থীরা যে গুরুতর অন্যায়ের শিকার হয়েছেন, এই অনুভূতির গভীরতা অবমূল্যায়ন করা উচিত নয় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের।

আমাদের প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রীরা এমন অনেক বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করেছেন, যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে গভীর যন্ত্রণা ও তীব্র ঘৃণার অনুভূতি।

প্রচুর শিক্ষার্থীর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে তার কোনো বন্ধু বা সহপাঠী বা সহ-আন্দোলনকারী নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তারা তা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই দৃশ্য দেখার পর তাদের ভেতর যে মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে তা রাতারাতি নিরাময় হবে, সেটা আশা করা যায় না। নিরাময় কেবল তখনই সম্ভব, যখন কর্তৃপক্ষ আইনি হয়রানি থেকে শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ মুক্তির বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সঙ্গে প্রকৃত বোঝাপড়া করবে, তাদের উদ্বেগ কমানোর ব্যবস্থা করবে এবং তাদের প্রতি প্রকৃত অর্থে সংবেদনশীল হবে।

এটা খুবই জরুরি। কারণ, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অনেককে বছরের পর বছর পুলিশি তদন্তের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে এবং জামিন নিতে হয়েছে। এসব আইনি লড়াইয়ে তাদের অর্থ খরচ হয়েছে, যা অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা এটা জানেন, তাদের সেই স্মৃতি মনে আছে এবং এখন সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির ভয় পাচ্ছেন।

মাত্র দুই সপ্তাহ ধরে চলা ছাত্র আন্দোলনের কাঁধে চেপে রাষ্ট্রবিরোধীরা এত বড় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারল, যা আমাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একক কর্তৃত্বে থাকা সরকারের অধীনে কীভাবে এটা হতে পারে?

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার দেড় দশক ধরে সর্বোচ্চ সময় ক্ষমতায় থেকে হঠাৎ দেখতে পাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো এমন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি সবই ব্যর্থ; এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হলো। এটা আমাদেরকে ভয়াবহভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, ক্ষমতাসীন দল ও সরকার গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে যে নীতি ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, সেগুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে কি না? শীর্ষ থেকে তৃণমূলের নেতারা যথাযথ ও আদর্শগতভাবে দলের জন্য কাজ করছেন কি না? নাকি দলটি অভ্যন্তরীণ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির দায়ে এখন প্রশ্নবিদ্ধ? এসব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন প্রয়োজন।

এই সময়কালের মূল্যায়ন যতটা জনগণের স্বার্থে হওয়া দরকার, ঠিক ততটাই দরকার ক্ষমতাসীন দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। আমাদের প্রশ্ন, একইসঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দলটি—যারা সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল—পথভ্রষ্ট হয়ে অর্থ আয়ের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে কি না? তৃণমূলে তাদের অবস্থান এখন কেবল গৌরবময় অতীতের ফ্যাঁকাসে ছায়ার মতো। তাদের নেতারা অকপটে স্বীকার করছেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামের নীতি, সততা, দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের নৈতিক শক্তি নয়, পেশিশক্তিই তাদের টিকে থাকার একমাত্র কৌশল।

একই সময়ে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিগত তিনটি নির্বাচন—২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সাল—ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল তুলনামূলক প্রতিযোগিতামূলক। কারণ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের 'বিদ্রোহী প্রার্থী'দের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

এখনকার নির্বাচনে বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ, আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের অর্থ-পেশিশক্তির অতিরঞ্জন এবং সেখানে ভোটাররা সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। 'নিজের পায়ে কুড়াল মারা' নীতিতে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ক্ষমতাসীনদের জন্য নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছে।

নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের সুস্পষ্ট ফলাফল নিয়ন্ত্রিত সংসদ। এর কারণে দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে সংসদে কোনো বিতর্ক হয়নি।

ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ও নির্বাচনে কারা জিততে পারে তা সহজে অনুমেয় হওয়ায় আমলা, পুলিশ, গোয়েন্দা, অন্যান্য সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান—এককথায় সরকারি চাকরিরত সবাই জানতেন যে রুটির কোন দিকটায় মাখন আছে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতির কারণে বাংলাদেশে দুর্নীতির সূচক ঊর্ধ্বগামী এবং ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান এত বেড়েছে, যতটা আগে কখনো ছিল না।

আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ক্রমশ ও উদ্বেগজনক অবক্ষয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকরণ দেখেছি, যা সুশাসনকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে।

ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের কোনোটিই জিজ্ঞাসা করা হবে না, বরং গতানুগতিকভাবে 'শত্রু'রাই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বলে প্রাধান্য পাবে আমাদের চিন্তা ও কথায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেই একই উপায় অবলম্বন করা হবে যা আমরা অতীতে দেখেছি এবং বছরের পর বছর শুনে আসছি।

এই কঠিন সময়ে অবশ্যই বুঝতে হবে যে 'যা আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে, তা আমাদেরকে সেখানে (উন্নয়নের উচ্চস্তরে) পৌঁছে দেবে না' (মার্শাল গোল্ডস্মিথের বইয়ের শিরোনামের অনুপ্রেরণায়)। আমাদের চিন্তা ও আচরণে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে হবে। এখনকার তরুণরা আগের চেয়েও বেশি স্মার্ট, বুদ্ধিমান, প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ও আত্মবিশ্বাসী।

তারা একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়তে চান এবং সেই প্রচেষ্টায় আমাদের সবার সমর্থন রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হত্যা, নির্যাতন, হুমকি ও ভয় দেখিয়ে কি সেই 'স্মার্ট বাংলাদেশে'র গর্বিত অংশীদার বানানো যাবে? যদি মনে করে থাকি যে তাদেরকে মেরে, নির্যাতন করে, ভয় দেখিয়ে নত করতে পারব, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই বোকার স্বর্গে বাস করছি।

তাদের মন ও মনন জিতে নিতে হবে, মাথায় আঘাত নয়। যেভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের 'মোকাবিলা' করা হলো, এতে মেধা পাচার বাড়বে। এআই বিশ্ব প্রতিভাবানদের নিয়ে গ্লোবাল ভিলেজ গড়ে তুলবে এবং কোনো নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় তাদেরকে আটকে রাখা যাবে না।

'ষড়যন্ত্র' আখ্যানে জোর দিয়ে এবং একইসঙ্গে এতগুলো মানুষের প্রাণ হারানোর বিষয়টি উপেক্ষা করে হয়তো খানিকটা অবকাশ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থা তৈরির উপায় নয়। আসলেই আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। তা না হলে আমাদের ভুলগুলো সংশোধনের বদলে বারবার হতে থাকবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে আমাদের খুব বেশি সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই যত শিগগির সম্ভব আমরা যেন আমাদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ক্ষমতাসীনরা যা বলে, আর জনগণ যা বিশ্বাস করে—তা এক নাও হতে পারে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ আল আমীন

Comments