মেডিকেল শিক্ষার্থীদের চোখে আন্দোলন ও সহিংসতা
ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের প্রায় সব বৃহৎ আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন চিকিৎসকরা। সাম্প্রতিক শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তারা অংশ নিয়েছেন—হয় রাস্তায় নেমে, নয়ত জরুরি বিভাগের দায়িত্বে।
ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি অনলাইন ও রাজপথে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছেন।
মেডিকেলের এক শিক্ষার্থী আকাশ চৌধুরী বলেন, 'মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রতিবাদ করা কঠিন, কারণ আমরা সংখ্যায় খুব কম এবং আমাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। তারপরও আমরা কথা বলছি। কোটা আন্দোলন যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন আমিও বন্ধুদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি।
শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট বাহিনীর হামলার ঘটনায় ১৬ জুলাই প্রায় সব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ছোট বা বড় পরিসরে প্রতিবাদ করেছে। আমরাও করেছি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেডিকেল কলেজও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন আমরা হাসপাতালে আসা আহতদের জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং সেবাদানে আমরা বৈষম্য করছি না।'
কোটা সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রায়ই নির্মম নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে একাধিকবার হামলা করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে কীভাবে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং রড দিয়ে শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন এই কলেজের শিক্ষার্থী আদিত্য রায়।
তিনি বলেন, 'ক্যাম্পাসে ফিরলে আবারও আমাদের মারধর করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তারা হিট লিস্ট তৈরি করেছে। আমরা কীভাবে ক্যাম্পাসে ফিরব?'
শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকলেও, মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাজ করেছে। অন্য একটি মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী মকবুল আহমেদ বলেন, 'আমি এবং আমার দুই বন্ধু গত ১৯ জুলাই সকালে কলেজে যাই। জরুরি বিভাগে প্রবেশের পর যাত্রাবাড়ী থেকে রাবার বুলেটের আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের আসতে দেখি। মাথায় ইটের আঘাতে আট বছর বয়সী এক শিশু আহত হয়েছিল। তার মাথায় সেলাই করলাম। আমাদের দুটি জরুরি রুম আছে, প্রতিটিতে দুটি বেড আছে। জুনিয়ররা সাহায্য করার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো।'
'জুমার নামাজের পর রোগীর ঢল নামতে থাকে। দুটি ইমার্জেন্সি রুমের প্রতিটিতে পাঁচজন রোগীর চিকিৎসা চলছিল। ইমার্জেন্সি রুমের বাইরে ছিল স্ট্রেচারে করে রোগীদের লাইন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা প্রশিক্ষণ পেয়েছি। কিন্তু এটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মতো,' যোগ করেন তিনি।
কেমন ধরনের রোগী দেখেছেন, জানতে চাইলে মকবুল বলেন, 'প্রায় সবার শরীরে বন্দুকের গুলির জখম ছিল। আমি ১৫ বছর বয়সী একজনকে দেখেছি তার মূত্রাশয়ে গুলি লেগেছে। আরেক রোগীকে দেখেছি পায়ে ছিঁড়ে যাওয়া ধমনী থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আমরা তার ক্ষত গজ-কাপড় দিয়ে বেঁধে দেই। কিছুটা স্থিতিশীল হলে, আমরা তাকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশনে (পঙ্গু হাসপাতাল) রেফার করি। দ্রুত তিনি সেখানে পৌঁছাতে না পারলে, তার পা কেটে ফেলতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'নুর নামে এক শিক্ষার্থীর কথা মনে পড়ছে। তার বুকের একটু উপরে ক্ষত দেখতে পাই। অল্পের জন্য একটি বুলেট তার হৃদপিণ্ডে আঘাত করেনি, কিন্তু ফুসফুস ভেদ করে গেছে। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে তিনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। আমরা তার বুকে একটি নল লাগাই। আধা লিটার রক্ত বের হয়ে গেল। নুর বলছিলেন তিনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। তারপর যখন একটু শ্বাস নিতে পারলেন, তখনই জিজ্ঞাসা করলেন, পরেরদিন তিনি আবার আন্দোলনে যোগ দিতে পারবেন কি না। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী বলব।'
পঞ্চম বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী রাতুল হক বলেন, 'বৃহস্পতিবার থেকে আমরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলাম। দুপুর ১২টার পর রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে প্রথমে এক রিকশাচালক আসেন। এআইইউবির এক শিক্ষার্থীর বাম চোখের নিচে গুলি লেগেছে। রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত আহত রোগীরা আসতেই থাকলেন। বেশিরভাগই ছিলেন ছররা গুলির আঘাতে আহত। আমরা সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। প্রয়োজনে স্পেশালাইজড হাসপাতালে রেফার করেছি। একজন এসেছিলেন তার বাম চোখে বুলেট আঘাত করে ডান চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন যখন গুলি লাগল। ভুলতে পারছি না ১৪ বছর বয়সী এক ছেলের কথা। তার পিঠে গুলি লেগেছিল। একটি শিশুর পিঠে কেউ কী করে গুলি করতে পারে?'
প্রতিটি আন্দোলনে প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে অংশ নিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক আন্দোলনে দেখা গেছে এক অসম সংঘর্ষ, যেখানে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছিল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। এমন বাস্তবতায় মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে কথা বলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি, মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজ করতে তারা তাদের দক্ষতা কাজে লাগাচ্ছে।
কঠিন প্রয়োজনে আমাদের মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা তাদের যোগ্যতা, সাহস এবং সেবা দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এমন প্রয়োজন কেন দেখা দেবে?
(এই লেখায় শিক্ষার্থীদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)
মেহরাব জামী: মেডিকেল শিক্ষার্থী ও সন্ধানীর কর্মী
mehrabjamee@gmail.com
Comments