ভ্যানে মরদেহের স্তূপের ভিডিওটি আশুলিয়া থানার পাশের
একটি ভ্যানের ওপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে কয়েকটি মরদেহ। মরদেহগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে চাদর দিয়ে। চাদরের ফাঁক দিয়ে মরদেহের হাত ও শরীরের অংশ দেখা যাচ্ছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পুলিশের জ্যাকেট পরা দুই ব্যক্তি একটি মরদেহ তুলে ভ্যানের ওপর ছুঁড়ে দিচ্ছেন। সেই ভ্যানের পাশ দিয়ে পুলিশ সদস্যরা হেঁটে যাচ্ছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপে এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওর সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় আশুলিয়া থানার সামনের সড়কেই একটি ভ্যানের ওপর লাশ স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। ভিডিওটি ধারণ করা হয় থানা ভবনের ঠিক সামনের তিন তলা ভবন থেকে।
ভিডিওর প্রথম ২০ সেকেন্ড সড়কে একটি নিথর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর পাশেই একটি ভ্যানে স্তূপ করে রাখা একাধিক মরদেহ দেখা যায়। একটি মরদেহের মুখ ছিল রক্তমাখা। দুইটি মরদেহের হাত ছড়িয়ে রাখা ছিল। কাপড় দিয়ে মরদেহগুলো ঢাকা ছিল। পাশে অস্ত্রধারী দুই পুলিশ সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ৩৫ সেকেন্ডের দিকে সড়কে পড়ে থাকা একটি মরদেহ তুলতে দেখা যায় দুই পুলিশ সদস্যকে। ৫৬ সেকেন্ডের দিকে দুই জনকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। আশপাশে আরও দুই জনকে দেখা যায়। তাদের একজনের হাতে ছিল অস্ত্র, আরেকজনের হাতে হেলমেট। ১ মিনিট ১৩ সেকেন্ডে দুই ব্যক্তি মরদেহগুলোর ওপরে একটি পিভিসি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেন। এর দুই সেকেন্ড পরই দুই জনকে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে দেখা যায়। পাশে ভ্যানের ওপর স্তূপ হয়ে থাকে মরদেহগুলো। ১ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের দিকে পাশে ৬-৭ জন পুলিশ সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের পেছনে বালুর বস্তা দিয়ে তৈরি করা দেয়াল। বালুর বস্তার দেয়ালের ঠিক পেছনে একটি হলুদ রংয়ের দেয়াল, নিচে কালো রং করা। দেয়ালের প্রায় তিন ফুট ওপরে একটি পোস্টার সাঁটানো। দেয়ালের পাশে অসংখ্য জুতা। আশপাশে নজর রাখতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের।
মূলত ওই দেয়াল ও পোস্টারটির সূত্র ধরেই শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এটি আশুলিয়া থানার সংলগ্ন ইসলাম পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লি. অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের সীমানা দেয়াল।
আশুলিয়া প্রেসক্লাবের পেছনের সড়ক দিয়ে থানা রোড অতিক্রম করে এসবি অফিসের দিকে যাওয়ার সময় ডান পাশের ওই দেয়ালের সঙ্গে ভিডিওতে দেখানো ঘটনাস্থল হুবহু মিলে যায়।
ভিডিওতে যে পোস্টারটি দেখা যায়, সেটি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী মো. আবুল হোসেন ভূঁইয়ার। পুলিশের বালুর বস্তার দেয়াল সরিয়ে ফেলা হলেও পাশের দেয়ালে এখনও পোস্টারটি সাঁটানো আছে।
বালুর বস্তার দেয়ালের অপর পাশে থাকা সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি ও মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোকানি ফাহিমা বেগম বলেন, ভিডিওতে যে জায়গাটি দেখা যাচ্ছে এটি আমার দোকানের সামনের। পাশেই ভ্যানের সবজি বিক্রেতা বিল্লাল হোসেনও এই জায়গাটি চিহ্নিত করেন।
স্থানীয়রা বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে ৫ আগস্ট সকাল থেকে আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল মোড়ের দিকে আন্দোলনকারীরা জড়ো হন। সেখানে পুলিশের সঙ্গে একটানা সংঘর্ষ চলে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আন্দোলনকারীরা থানার দিকে আসতে শুরু করেন। এসময় মসজিদের মাইক ও হ্যান্ড মাইকে থানার পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করার ঘোষণা দেন। এরপরও আন্দোলনকারীরা থানার দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ওই সময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হন। ওই মরদেহগুলোই হয়তো ভ্যানে তোলা হয়ে থাকতে পারে।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (নিরস্ত্র) আরাফাত হোসেনকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। ভিডিওতে আংশিক দেখা গেছে আশুলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মাসুদুর রহমানকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশুলিয়া থানার একাধিক পুলিশ সদস্য দাবি করেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাবার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা একটি ভ্যানে করে মরদেহগুলো নিয়ে এসে থানায় আক্রমণ করে। সেই সময় থানার ভেতর থেকে আন্দোলনকারীদের টিয়ারশেল ও ছররা গুলি ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করা হয়। আন্দোলনকারীরা প্রথম দফায় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে কিছু পুলিশ সদস্য থানা ত্যাগ করেন। ভ্যানের পাশে পরে থাকা মরদেহটি ওই ভ্যান থেকেই পড়ে গিয়েছিল। পরে পুলিশ সদস্যরা ভ্যানে মরদেহটি তোলেন।
ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ ভিডিওতে আরাফাত হোসেনকে চিহ্নিত করেন৷ তবে তিনি নিরস্ত্র ছিলেন দাবি করে তিনি বলেন, ডিবির কাছে ভারী অস্ত্র ছিল না। তারা কেউ গুলি করেনি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক পুলিশ সদস্য জানান, ওসি মাসুদুরের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশ সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ বলেন, ভিডিওটি শনাক্ত করার জন্য সাইবার ক্রাইম ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে আমরা কাজ করছি। আইনগতভাবে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য গত ৫ আগস্ট সাভারে অন্তত ৪৬ জন নিহতের তথ্য পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। পুলিশের নিহত হন তিন জন। এরমধ্যে দুজনকে হত্যার পর নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় একটি ওভারব্রিজ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এক পুলিশ সদস্যের পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া থানা সংলগ্ন এলাকায় একটি পুলিশ ভ্যানে তিনটি পোড়া মরদেহ পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় ২০টির বেশি মামলা হয়েছে।
Comments