রাজাকার বাছিতে দেশ উজাড়
বাংলা ভাষায় 'ঠক বাছিতে গাঁ উজাড়' শিরোনামে একটি প্রবচন আছে। যার অর্থ প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক বা খারাপ লোক বাছাই করতে গিয়ে বিপদে পড়া। এক ধরনের সংকট বোঝাতে এই প্রবচনটি ব্যবহার করা হয়। গ্রাম্য এই প্রবচনটি শিরোনাম করে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার অধিকৃত ঢাকায় দৈনিক ইত্তেফাকে একটি রাজনৈতিক পর্যালোচনা লিখেছিলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। সংবাদপত্রটির কার্য-নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সিরাজুদ্দীন হোসেনের এই বিশ্লেষণধর্মী লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। রাজনৈতিক এই পর্যালোচনার বিষয়বস্তু ছিল সাচ্চা পাকিস্তান প্রেমিক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে নিষিদ্ধ ছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানে হারিয়ে ফেলা লাগাম নিয়ন্ত্রণে আনার শেষ চেষ্টা হিসেবে ডাক্তার মালেককে গভর্নরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। তার নেতৃত্বেই গঠিত হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক মন্ত্রিসভা। আর ওই মন্ত্রিসভা গঠনের সময়েই সামনে আসে কে আসলে দেশপ্রেমিক আর কে বিচ্ছিন্নতাবাদী—এই প্রশ্নটি। তা নিয়েই ছিল বিশ্লেষণ।
ওই নিবন্ধে সেই সময় সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট দুটি দলের নেতার কথা উল্লেখ করেছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। 'বিগত নির্বাচন প্রমাণ করিয়াছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনই দেশপ্রেমের সুনির্দিষ্ট সার্টিফিকেট নয়'—এই কথাটি ছিল জামায়াত ইসলামীর অস্থায়ী আমির মিয়া তোফায়েলের। আর কাইয়ুম লীগের প্রধান কাইয়ুম খানের দাবি ছিল, কেবল তার দল ব্যতীত পশ্চিমাঞ্চলের আর সব দলই বিচ্ছিন্নতাবাদী, নয়তো শত্রুদেশের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত চর অথবা দেশের দুশমন। মূল কথা দেশপ্রেমিক খুঁজতে গিয়ে ঠক বাছিতে গাঁ উজাড় অবস্থা।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের এই লেখাটি দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি দেখে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে নতুন করে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হলো। মাত্র কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা নিয়ে অভূতপূর্ব এক প্রতিবাদের পর নজিরবিহীন সহিংস ঘটনা ঘটে গেছে দেশে। এর আগে এত প্রাণহানি, এত ধ্বংসযজ্ঞ স্বাধীন বাংলাদেশে কখনই ঘটেনি। কী ভয়াবহ, আতঙ্কিত কয়েকটি দিন। তখনই ভাবছিলাম এই রাষ্ট্রযন্ত্রে আসল রাজাকার কারা? কী তাদের পরিচয়? তাদের তালিকা তৈরি করতে না পারার কারণেই কি ২০২৪ সালে এসে দেশ উজাড় হওয়ার জোগাড় হলো?
রাজাকার শব্দটি ফার্সি। এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবী। ১৯৭১ সালে মে মাসে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নিয়ে খুলনায় এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে এটিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে রূপান্তর করে। পরে ৭ সেপ্টেম্বর জারি করা আরেকটি অধ্যাদেশে এই বাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের বিভিন্ন নথিপত্রে এই বাহিনীর সদস্যদের নাম-পদবি আছে। আছে ভাতাগ্রহীতাদের তালিকাও।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ কে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে এই বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তার পাশাপাশি এই বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, তা বাঙালি জাতি কখনই ভোলেনি। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশে রাজাকাররা আজও ঘৃণিত, বর্জিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের অভূতপূর্ব উত্থানের সময় এই রাজাকার শব্দটি উচ্চস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল। প্রকম্পিত করেছিল আকাশ বাতাস। 'ক' তে কাদের মোল্লা... তুই রাজাকার, তুই রাজাকার—এই স্লোগানে প্রকম্পিত আটলান্টিক পাড়ের শহরগুলোও। ঘৃণ্য অপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপটে রাজাকার শব্দটির ব্যবহার যৌক্তিক হলেও পরের দিকে ক্ষমতাসীনরা একে এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। কোনো বিষয়ে কেউ যখন যৌক্তিকভাবে সরকার-বিরোধী অবস্থান নিয়েছে, অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে, তখনই তাদের দেওয়া হয়েছে ঘৃণাসূচক রাজাকার তকমা। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদেরকেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বারবার রাজাকার বলা হয়েছে। বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিবিদও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভাষায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেছিলেন। তার মতো ছাত্ররাজনীতি করে আসা একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এমন বক্তব্য ছিল চূড়ান্ত রকমের হাতাশার ও লজ্জার।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রায় এক কোটি মানুষ। খুব সম্ভবত সেই সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজারের মতো। আর রাজাকার? নিশ্চিতভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতে বেশি নয়। আমি মুক্তিযোদ্ধা গবেষক নই। তারপরও আমার ধারণা, এই সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হবে না। যুদ্ধদিনে অনেকেই আবার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য এই বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন। তালিকাভুক্ত রাজাকার হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন এমন নজিরও আছে। অনেকেই আবার রাজাকার সদস্য হলেও কোনো অবস্থাতেই হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো অপরাধে যুক্ত ছিলেন না।
তবে হ্যাঁ, অবশ্যই রাজাকারদের বড় একটি অংশ মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর অপরাধের সঙ্গী ছিলেন। প্রায় ১০ বছর আগে এই রাজাকারদের তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছিল বর্তমান সরকার। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকার, আলবদর ও আলশামস সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশিত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম যুক্ত হয়েছে, আর বাদ পড়েছে চিহ্নিত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের নাম। প্রবল প্রতিবাদ ও আপত্তির মুখে এটি প্রত্যাহার করে নেয় সরকার।
পরে ২০২২ সালে আইন সংশোধন করে এই তালিকা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল—প্রায় পাঁচ বছর হতে চললেও এই তালিকা প্রকাশের কোনো অগ্রগতি নেই। কেন থেমে আছে এই কাজ? ২০২৪ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এই কাজ এখন প্রায় স্থবির। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন জানিয়েছেন, 'রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে গেলে শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম অথবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের নাম চলে এসেছে। এমন ব্যক্তিদের নাম আসছে, যাঁরা অনেক বড় বড় অবস্থানে আছেন। রাজাকারের আত্মীয়স্বজন যেমন প্রশাসনে আছেন, তেমন ক্ষমতাসীনদের দলেও আছেন। ফলে তাঁরা এই তালিকা করতে এগোতে সাহস পাচ্ছেন না।' (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ, ২০২৪)
এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। রাজাকার বাছিতে দেশ উজাড় অবস্থা। রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রাজাকারের তালিকা অবশ্যই থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরা একটানা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করেও কেন রাজাকারের একটি গ্রহণযোগ্য তালিকা করতে পারল না? এই ব্যর্থতা কার?
গণতান্ত্রিক সমাজে কোনো ধরনের সমালোচনা ও দাবি তুললে যাকে-তাকে রাজাকার তকমা দেওয়ার মতলব মানুষ ধরে ফেলেছে। সুশাসন থেকে বঞ্চিত, পদে পদে বৈষম্যের শিকার, দুর্নীতিপিড়ীত, দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে পিষ্ঠ মানুষকে আর রাজাকার তকমা দিয়ে দানবীকরণ করে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সেই দিন শেষ হয়ে গেছে।
তবে হ্যাঁ, কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতলব ছাড়া বর্তমান সরকার যদি এখনো রাজাকারের তালিকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়—সেটা সাধুবাদযোগ্য। আমি মনে করি সেটা এই সরকারের করা উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক মতলব ছাড়া সরকার এই কাজে আবার সময় ব্যয় করবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Comments