হাটে গরু অনেক, ক্রেতা কম

লালমনিরহাটের বড়বাড়ী পশুর হাট থেকে তোলা ছবি। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

ঈদুল আজহার বাকি তিন দিন। দেশের কোরবানির পশুর হাটগুলোতে নিজেদের লালন করা গরুসহ অন্যান্য পশু নিয়ে এসেছেন খামারিরা। পাবনা ও রংপুরের পাঁচ জেলার হাটগুলোতে কোরবানির পশুর সরবরাহ বেশি থাকলেও ক্রেতা নেই বলছেন বিক্রেতারা। অন্যদিকে দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেন না বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা।

রংপুরের ৭৮ পশুরহাট

রংপুরের পাঁচ জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীর ৭৮টি পশুরহাটে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতাই বেশি। ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুরহাটে গরুর সরবরাহ বেড়েছে। তবে ক্রেতা সংকটের কারণে আশানুরূপ বিক্রি করতে পারছেন না গরু খামারিরা।

কোরবানির পশুর হাটে সরবরাহ বেশি হলেও দাম চড়া বলছেন ক্রেতারা। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর পশুরহাটের ইজারাদার সদস্য আফতার উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রতি হাটের দিন যাত্রাপুর হাটে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার গরু বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে কিন্তু মাত্র ৭০০-৭৫০টি গবাদি পশু বিক্রি হচ্ছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ি পশুরহাটের ইজারাদার সদস্য মেহেরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গরুর খামারিরা আশানুরূপ দামে গরু বিক্রির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও ক্রেতা না থাকায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। সরবরাহকৃত গবাদি পশুর মাত্র ২০-২৫ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে। প্রতি হাটের দিনে প্রায় ৬-৭ হাজার গবাদি পশু সরবরাহ করা হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার চর জোড়গাছ এলাকার গরু খামারি সোহরাব হোসেন (৬০) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি বিক্রির জন্য দুটি গরু এনেছিলেন কিন্তু একটি বিক্রি করেছেন। দাম কম হওয়ায় তিনি ও অন্য খামারিরা তাদের গরু বিক্রি না করেই বাড়ি ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারে টাকার প্রয়োজন হওয়ায় একটি গরু ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন, কিন্তু এক মাস আগে এই গরুর দাম ছিল ৭০ হাজার টাকা। এ বছর গরু পালন করে আশানুরূপ লাভ করতে পারেননি বলে জানান তিনি।

কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর পশুরহাট থেকে তোলা ছবি। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

লালমনিরহাট সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা গ্রামের খামারি দিলবর রহমান (৬৫) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গরু লালন-পালন করে কোনো লাভ করতে পারছেন না। পশুখাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। তার দুটি গরু আছে। তিনি দুটি গরু বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু দাম কম হওয়ায় সেগুলো বাড়িতে ফেরত এনেছেন।

রংপুরের কাউনিয়া পশুরহাটের গরু ক্রেতা সগীর উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এ বছর কোরবানির জন্য ৯ হাজার টাকায় একটি ছাগল কিনলেও গত বছর ৬০ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছিলেন। টাকার অভাবে এ বছর গরু কিনতে পারেননি তিনি। প্রতিবেশীদের অবস্থা তার মতোই।'

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে রংপুর অঞ্চলের পশুরহাটে প্রায় তিন লাখ গরু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। হাটে চাহিদার তুলনায় গরুর সরবরাহ বেশি।

লালমনিরহাটের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ডিএলও) ডা. জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, চর এলাকার খামারিরা গরু বিক্রির জন্য পশুরহাটে ভিড় করলেও ক্রেতা না থাকায় তারা হতাশ। অনেক খামারি তাদের পারিবারিক কাজে অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় কম দামে গরু বিক্রি করছেন। তখন ক্রেতারা তাদের পছন্দমতো গবাদি পশু সাশ্রয়ি দামে কিনতে পারছেন।

পাবনায় সরবরাহ বেশি থাকলেও গরুর চড়া দাম

পাবনার কোরবানির পশুর হাটগুলোতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলেও দামও বেশি। বেচাবিক্রি আশানুরূপ না হলেও শুক্রবার থেকে বিক্রি বাড়বে আশা বিক্রেতাদের। পাবনার আটঘরিয়ার একদন্ত হাট থেকে তোলা ছবি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/ স্টার

পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার ইদিলপুর গ্রামের ব্যবসায়ী মজিবর রহমান তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ওজনের একটি গরু কেনার জন্য গত এক সপ্তাহে তিনটি হাট ঘুরেছেন কিন্তু বাজেটের মধ্যে পছন্দের পশু কিনতে পারেননি।

মজিবর জানান, এক লাখ থেকে সোয়া এক লাখ টাকার মধ্যে গরু কেনার জন্য এক হাট থেকে আরেক হাটে ঘুরে বাজেটের মধ্যে পছন্দের গরু মেলাতে পারিনি।

তিন মণের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ওপরে, সাড়ে তিন মণের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর গরুর দাম অনেক বেশি চাওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ভালো দাম পাওয়ার আশায় গরু ছাড়তে চাচ্ছে না খামারিরা ফলে পছন্দের গরু কিনতে এক হাট থেকে আরেক হাটে ঘুরতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

একই উপজেলার ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি এক লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে গরু কেনার জন্য হাটে এসে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনতে হয়েছে। বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৮ হাজার টাকা বেশি দিয়ে গরু কিনতে হয়েছে তাকে।

সরেজমিনে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত হাট, চাটমোহর উপজেলার রেল বাজার হাট, ভাঙ্গুরা উপজেলার শরতনগর হাট ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি হাটেই পর্যাপ্ত কোরবানির পশু আমদানি হচ্ছে তবে দাম অনেক বেশি।

ব্যবসায়ীরা জানায়, পাঁচ মণের ওপরের গরু ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা মণের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে, তবে পাঁচ মণের নিচে ছোট ও মাঝারি গরুর দাম আকাশচুম্বি। স্থানভেদে এসব গরু ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি থাকায় ব্যবসায়ীরা এসব গরুর দাম হাকাচ্ছেন অনেক বেশি।

পাবনার আটঘরিয়ার একদন্ত হাট থেকে তোলা ছবি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/ স্টার

তবে খামারিরা জানান, গরু মোটাতাজাকরণ ও খামারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় গরু পালন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

পাবনা জেলা ডেইরি ফার্ম মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে ভূষি কিনে গরুকে খাওয়াতে হচ্ছে খামারিদের। পাশাপাশি খামারের অন্যান্য খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মণপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়ছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার বাজারে গরুর দাম কিছুটা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে খামারিরা লাভবান হতে পারছে না বলে জানান তিনি।

পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার খামারি বাবু প্রামাণিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সারা বছর অনেক পরিশ্রম করে তিলে তিলে অর্থ ব্যয় করে একটি পশু কোরবানির হাটে নিয়ে এসে উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

খামারিদের কারণে পশুর দাম বাড়েনি বলে দাবি করে তিনি বলেন, বেশিরভাগ খামারিরাই ব্যবসায়ীদের কাছে গরু বিক্রি করে দেয়। হাটে বেশিরভাগ গরু থাকে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে, খুব স্বল্প সংখ্যক গরু খামারিদের কাছে থাকে। আর ব্যবসায়িরা তাদের কাঙ্ক্ষিত লাভ না পাওয়া পর্যন্ত পশু বিক্রি করে না বলে জানান তিনি।

পাবনার আটঘরিয়ার একদন্ত হাট থেকে তোলা ছবি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/ স্টার

এদিকে ঈদ ঘনিয়ে আসায় গবাদি পশু সমৃদ্ধ পাবনার প্রতিটি হাটে কোরবানির পশুর ব্যাপক আমদানি হলেও এখনও কাঙ্ক্ষিত ঈদের বেচাকেনা নেই বলে জানান ব্যবসায়ী ও খামারিরা।

পাবনার সাথিয়া উপজেলার বিল চাপরি গ্রামের গরু ব্যবসায়ী আব্দুল গফফার জানান, গত বছর ঈদের আগে প্রতি হাটে কমপক্ষে ৫ টি গরু বিক্রি করলেও এ বছর প্রতি হাটে ২ টির বেশি গরু এখনও বিক্রি করতে পারেননি।

তবে শুক্রবার থেকে হাটে ভিড় বাড়বে এবং বেচাকেনাও অনেক বেশি হবে বলে জানান তিনি।

পাবনার আটঘরিয়ার একদন্ত হাট থেকে তোলা ছবি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/ স্টার

এদিকে গরুর দাম বাড়ার পাশাপাশি কোরবানির হাটে ছাগলের দামও এবার অনেক বেশি। ক্রেতারা জানান, ১৫ কেজি ওজনের ছাগল ২০ হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে।

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, পাবনায় এ বছর ৩ দশমিক ১২ লাখ কোরবানির পশুর চাহিদা থাকলেও ইতোমধ্যে ৬ দশমিক ৩৪ লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত কোরবানির পশু দেশের অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus calls for working together amid global challenges

Highlights importance of building an economy where fruits of technology, growth are shared evenly by all people

21m ago