রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে আরও ১৯ হাজার বিঘা জমিতে তামাক চাষ

রংপুর অঞ্চলে মোট উৎপাদিত তামাকের ৭০ শতাংশই আসে লালমনিরহাট থেকে। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

চলতি বছর বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ১৩ হাজার ৩৪৯ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় যা ২ হাজার ৫২৯ হেক্টর অর্থাৎ  ১৯ হাজার বিঘা বেশি।

তামাক চাষের এই হিসাব সরকারের কৃষি বিভাগের। তবে তামাকবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দাবি, তামাক চাষে ব্যবহৃত প্রকৃত জমির পরিমাণ এর চেয়ে আরও অনেক বেশি।

এর বিপরীতে এ অঞ্চলে চলতি বছর ৩ হাজার ১৮৩ হেক্টর জমিতে গম চাষের আওতা কমেছে । চলতি বছর রংপুর অঞ্চলে গমের চাষ হয়েছে ১৭ হাজার ১৬৭ হেক্টর জমিতে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৩৫০ হেক্টর। আর পাঁচ বছর আগে এ অঞ্চলে গম চাষ হয়েছিল ২৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, তামাক চাষের বিরুদ্ধে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেও কৃষকদের তামাক চাষ থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। আবার কার্যকর কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। এ সুযোগে কোম্পানিগুলো কৃষকদের অগ্রিম টাকাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। ফলে, বেশি লাভের আশায় কৃষকেরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এতে পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার পাশাপাশি এ অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে, এ অঞ্চলে উৎপাদিত মোট তামাকের ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় লালমনিরহাট জেলায়। এর পরের অবস্থান রংপুর ও নীলফামারীর। রংপুরের মমিনপুরের পাশাপাশি লালমনিরহাটের সারপুকুর, সাপ্টিবাড়ী, ভাদাই, দূর্গাপুর ও কাকিনাকে বলা হয় তামাকের ইউনিয়ন।

রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের মুটুকপুর গ্রামের কৃষক ওসমান আলী (৬০) গত বছর তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছিলেন। এ বছর অধিক মুনাফার আশায় তিনি তামাক চাষের জন্য আরও দুই বিঘা জমি বাড়িয়েছেন।  

বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেও কৃষকদের তামাক চাষ থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

ওসমান আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাত-আট বছর আগেও তিনি তার আট বিঘা জমির পুরোটাই ব্যবহার করতেন ধান, সরিষা ও গমসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদনের কাজে। গত বছর তিন বিঘা জমি থেকে তিনি ২১ মন তামাক পেয়েছিলেন। উৎপাদিত তামাক বিক্রি করেছিলেন ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকায়। এতে তার খরচ হয়েছিল ৩৮ হাজার টাকা।

এ বছর তামাক কোম্পানিগুলো আরও বেশি মুনাফার আভাস দেওয়া ওসমান আলী আরও দুই বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন বলে জানান। বলেন, 'তামাক চাষে পরিশ্রম বেশি, লাভও বেশি। কোম্পানিগুলোই আমাদের তামাক কিনে নেয়। এছাড়া বিনামূল্যের বীজ, সার ও কীটনাশক সুবিধা পেয়ে থাকি আমরা। সুদমুক্ত ঋণ সুবিধাও পাওয়া যায়।'

একই গ্রামের আরেক কৃষক মির্জা রহমানের (৬২) বক্তব্য, তামাক চাষের কারনে মমিনপুর ইউনিয়নে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে গেছে। তিনিও এ বছর ‍দুই বিঘার জায়গায় চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছন। তিনি বলেন, উৎপাদিত তামাক বিক্রি করা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু অন্য ফসলের ক্ষেত্রে ভালো দাম পাওয়া নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়।

মির্জা রহমানের ধারণা, এসব কারণে আগামী এই এলাকায় তামাক চাষ আরও বাড়বে।  

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর গ্রামের ধীরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৫) গত ৩০ বছর ধরে তামাক চাষে যুক্ত। এ বছর তিনি তামাক চাষ করেছেন ১২ বিঘা জমিতে। গত বছর তা ছিল ৪ বিঘা।

কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা গ্রামের নবির হোসেনও (৬০) চলতি বছর বাড়তি তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষের কথা জানান।

তামাকবিরোধী জোট অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের সদস্য খোরশেদ আলমের দাবি, কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যের চেয়ে দ্বিগুণ জমিতে এবার তামাকের চাষ হচ্ছে।

খোরশেদ আলম বলেন, এ অঞ্চলে সাতটি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। মৌসুমে প্রতিটি কোম্পানির ৭০ লাখ থেকে এক কোটি কেজি তামাক কেনার লক্ষ্যমাত্রা থাকে। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা দেওয়া বন্ধ না করা গেলে তামাক চাষ কমানো যাবে না। পরিস্থিতি আগামীতে আরও ভয়াবহ হবে।

তামাক চাষের আওতা বাড়ার কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যে কমে আসছে, তা স্বীকার করেন আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুকও। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিধিনিষেধ না থাকায় তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দা সিফাত জাহানেরও ভাষ্য, খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে উঠেছে তামাক চাষের বিষয়টি। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কার্যকর কোনো পদক্ষেপ ছাড়া তামাক চাষ কমানো যাচ্ছে না। কৃষি বিভাগ কেবল তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদের কাছে তুলে ধরে। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে না।'

তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, তামাক গাছে প্রচুর শিকড় ধাকে। এ কারণে তামাক গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমান খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তামাক গাছের খাদ্য নিশ্চিত করতে জমিতে প্রচুর পরিমান রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন কৃষকরা। এতে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। তামাক চাষের পর পরবর্তীতে ওই জমিতে অন্য ফসলের আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। তামাক চাষ মাটির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। তামাক চাষের কারনে কৃষি পরিবারের সদস্যরাও সবসময় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন।

  

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

7h ago