শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশিরা

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

সংকটে থাকা অর্থনীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ক্রমাগত কমে যাওয়া ও সরকারের ঘনঘন নীতি পরিবর্তনের কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমার ধারা অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই নয় মাসে দেশের নীট বিদেশি বিনিয়োগ ৮৯ মিলিয়ন ডলার কমেছে। এটি এর আগের বছরের একই সময়ে ৪৫ মিলিয়ন ডলার কমেছিল।

বিদেশিরা ২০২০ সাল থেকেই তাদের শেয়ার বিক্রি শুরু করেন। কারণ তখন থেকেই তারা ভাবছিলেন যে, বাংলাদশের টাকার দাম ডলারের বিপরীতে অনেক কমতে পারে।

বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ দেখে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মৌখিক নির্দেশনা দেওয়ার পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য তখন থেকে দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিএসই) সভাপতি ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশিদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির মূল কারণ টাকার মান কমে যাওয়া ও ফ্লোর প্রাইস আরোপ।'

টাকার দাম কমে গেলে শেয়ারের দাম না কমলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা লোকসানে পড়েন। তারা যখন টাকার অবমূল্যায়নের আশঙ্কা করেন তখনই শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন।

এ ছাড়াও, দেশে চলমান ডলার সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। 'ফলে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন,' বলে মনে করেন তিনি।

গত দুই বছরে দেশের রিজার্ভ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, একই সময়ে ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

তদুপরি, পুঁজিবাজারের সূচকগুলোর ক্রমাগত পতন ঠেকাতে বিএসইসি ২০২০ সালে যখন ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালু করে, তখন এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপর চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ার বিক্রি কঠিন হওয়ায় এই ব্যবস্থাটি তাদের নিজেদের রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্সকে বাধার মুখে ফেলবে।

ধীরে ধীরে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝি তা আবার বসানো হয়।

'এটি বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার আরেকটি বড় কারণ,' যোগ করেন সাইফুল ইসলাম।

তিনি আশা করছেন যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার বিক্রির চাপ এখন কমবে। কারণ তারা ইতোমধ্যে তাদের হাতে থাকা শেয়ারের একটি বড় অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি ২০২০-২১ অর্থবছরে শুরু হয়েছিল। এখনো তা অব্যাহত আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশিরা নীট বিনিয়োগ ৩০ মিলিয়ন ডলার কমিয়েছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ১৫৮ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমায় ২৬৯ মিলিয়ন ডলার।

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, 'বিদেশিদের ব্যাপকহারে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার কারণে ব্লু-চিপ ও ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয়েছে।'

'বিদেশিদের বিক্রি করা শেয়ার কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা স্থানীয়দের নেই,' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ে কাজ করে এমন এক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন যে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো আরও খারাপ হতে পারে।'

'অর্থাৎ টাকার দাম আরও কমতে পারে। তাই তারা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন,' যোগ করেন তিনি।

ডলার সংকটের কারণে বেশিরভাগ ব্লু-চিপ ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ২০২৩ সালের জন্য লভ্যাংশ কমিয়েছে।

'সরকারের ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন বিদেশিদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'ফ্লোর প্রাইস আরোপের ফলে তারা পুরোপুরি সতর্ক হয়ে যান।'

ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পর শেয়ারের দরপতন ঠেকাতে লোয়ার সার্কিট ব্রেকার তিন শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

তার মতে, 'এটা আরেকটি ধাক্কা।'

'যেসব শেয়ারবাজার থেকে বের হওয়ার নিয়ম কঠিন সেসব বাজারে বিদেশিরা কখনই বিনিয়োগ করেন না। ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা, কড়া সার্কিট ব্রেকার ও ডলার ঘাটতিও এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

'এসব নীতিমালা দিয়ে বিক্রয় ব্যবস্থাকে সংকুচিত করা ছাড়া বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিএসইসির পক্ষ থেকে কী করা হয়েছে?'—এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'গত ১৫ বছরে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে যেখানে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে পারেন। তাহলে কেন তারা আসবেন?'

'শুধু রোড শো করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা যাবে না।'

অতীতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেক আকস্মিক সরকারি নীতি পরিবর্তনের মুখে পড়তে হয়েছিল। এটি তাদের বিনিয়োগকে প্রভাবিত করেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২২ সালের জুনে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনকে সিম বিক্রির নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

ছয় মাস পর তা তুলে নেওয়া হলেও এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম কমে যায় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তিতাস গ্যাসের বিতরণ চার্জ কমিয়ে দেয়। ফলে পাঁচ মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটি বাজারমূল্য হারায় তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি।

সেসব সময় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের একটি বড় অংশ ছিল বিদেশিদের হাতে।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

2h ago