লোনাপানিতে ভেসে গেছে সুন্দরবনের পুকুর, হুমকির মুখে বাস্তুতন্ত্র

রিমালের প্রভাবে সুন্দরবনে ধ্বংসযজ্ঞ। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বন্যপ্রাণীর খাবার পানির চাহিদা পূরণে যে ১৬টি পুকুর খোঁড়া হয়েছিল সেগুলোর সবগুলোই সাগরের লোনাপানিতে ভেসে গেছে। এতে পশুপাখির পাশাপাশি বনের ওপর নির্ভরশীল জেলে-বাওয়ালী ও বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পানির সংকটে পড়বেন।

বনবিভাগ ও সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুকুরগুলো থেকে দ্রুত লোনাপানি নিষ্কাশন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে বাস্তুতন্ত্র এবং সর্বোপরি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়তে পারে।

সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তার দপ্তরের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সুন্দরবনের স্বাদু পানির পুকুরগুলো ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে এই রেঞ্জে জীবজন্তু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া না গেলেও গাছপালার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করা যায়নি।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে চারটি স্টেশন ও ১২টি টহল ফাঁড়ি আছে। প্রতিটি স্টেশন ও টহল ফাঁড়িতে বন্যপ্রাণী ও জেলে-বাওয়ালীদের কথা চিন্তা করে পুকুর খনন করা হয়। পুকুরগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। এই পুকুরগুলোই জলোচ্ছ্বাসের লোনা পানিতে ভেসে গেছে।

সুন্দরবনে গত ৪০ বছর ধরে মধু ও মাছ আহরণ করেন শ্যামনগরের চকবার গ্রামের কামরুল গাজী (৬০)। তিনি জানান, তাদের একটানা দুই-তিন সপ্তাহ বনের ভেতর থাকতে হয়। লোকালয় থেকে যে পানি সঙ্গে করে নিয়ে যান তাতে চার-পাঁচ দিনের কাজ চলে। পরের দিনগুলো চলে বনবিভাগের পুকুরের পানি দিয়ে। কিন্তু এবার খাবার পানি নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।

চুনকুড়ি গ্রামের জাবের আলী গাজী (৫০) জানান, জীবিকার প্রয়োজনে তিনি গত ৩০ বছর ধরে বনে যাচ্ছেন। বনের ভেতরে পুকুরের পানিই একমাত্র ভরসা। সুন্দরবনের বাঘ থেকে শুরু করে সব প্রাণী এই পুকুরের পানি খায়। পুকুরগুলোতে লোনা পানিতে ভেসে গেলে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হবে।

জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, রুমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের ভেতরের স্বাদুপানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। এতে সুন্দরবনে খাবার পানি সংকট বাড়বে। প্রাণীকুল ছাড়াও সুন্দরবনে কর্মরত জেলে-বাওয়ালী ও বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংকটে পড়বে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্যশৃংখল বিনষ্ট হবে। লোনাপানিতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলো দ্রুত সেচে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সামনে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিরপানি দিয়ে ভরতে হবে। আপৎকালীন বিকল্প পানির ব্যবস্থা করতে হবে। 

রুমালের প্রভাবে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তিনি বলেন, রিমালের ধরণ ও প্রভাব অনেকটাই আইলা ও কিছুটা ফণী ও বুলবুলের মতো। সুন্দরবন দীর্ঘসময় জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে ছিল। এ কারণে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনতল। বনের নিচু স্তরের অণুজীব, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ম্যানগ্রোভ বীজের বেশি ক্ষতি হয়েছে। উদ বা ভোঁদড়, বেজি, গুইসাপ, ব্যাঙসহ বহু সরীসৃপ প্রাণীর সমস্যা হবে। হরিণ ও বুনো শূকরদের মৃত্যু এবং দীর্ঘমেয়াদী নানা অসুখ হতে পারে। বানর, বাঘ ও অজগর হয়তো কিছুটা নিরাপদে থাকতে পেরেছে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বন্যপ্রাণীরাও মানসিক অস্থিরতার ভেতর থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক হয়ে ওঠার জন্য কিছুদিন সুন্দরবনে বাণিজ্যিক পর্যটন বন্ধ রাখা দরকার। সর্বশেষ দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠিত হয়েছে। রুমালের কারণে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই তহবিল কাজে লাগাতে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা কেএম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, এই রেঞ্জের চারটি স্টেশন ও ১২টি টহল ফাঁড়িতে ১৬টি পুকুরই লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। হলদেবুনিয়া ও কাচিকাটায় ভবনে ফাটল ধরেছে। কালাগাছিয়া পর্যটন কেন্দ্রের ঘাট, সড়ক ও সেতু নষ্ট হয়ে এক কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে গাবুরা বুড়িগোয়ালিনী ও চুনকুড়ি এলাকায় ভেসে আসা তিনটি হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে গতকাল বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত কোনো জীবজন্তু মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব নেই।

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

1h ago