আদালতের নির্দেশ স্বত্ত্বেও সুন্দরবনে বন্ধ হচ্ছে না ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুন্দরবন ও এর আশেপাশের নদী-খালগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাবে এই প্লাস্টিকের ব্যবহার কোনোভাবেই কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। তাছাড়া ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার অভাবে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় অঞ্চলে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার দিনদিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবহারের উপযোগিতা ও সহজলভ্য হওয়ায় এটি এখন নিত্য ব্যবহার্য পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে।
দেশের উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহারের পর বর্জ্য হয়ে যায় এমন প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা আছে হাইকোর্টের। কিন্তু এ নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তৎপরতার অভাবে এটি কার্যকর করা যাচ্ছে না।
যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে লাগে না, সেগুলোই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ইতোমধ্যে তিন বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
খুলনা নগরীর দৌলতপুরের হোটেল ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান শেখ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৪-৫ বছর আগেও সিঙ্গেল প্লাস্টিকের ব্যবহার সেভাবে ছিল না। কিন্তু ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমি এখন এটি ব্যবহার করি। যদিও আমি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খুলনা করপোরেশনের নতুন রাস্তা মোড়ের এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার প্ল্যান্ট) প্ল্যান্টে ফেলে আসি।'
'করোনার সময় থেকে অধিকাংশ গ্রাহক একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিকের গ্লাস দিতে অনুরোধ করেন, অনেকেই আবার একবার ব্যবহার করা প্লেট চান। ব্যবসার কথা বিবেচনা করে আমি এসব ব্যবহার করি। আর সত্যি কথা বলতে এগুলো পরিষ্কার করার কোনো ঝামেলা থাকে না। শ্রম কম লাগে, ব্যয়ও হয় কম,' বলেন তিনি।
শুধু খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকার লবণচরা, টুটপাড়া, রূপসা, ফুলবাড়ি গেট অঞ্চলে কমপক্ষে ১৫-১৬টি প্লাস্টিকের কারখানা আছে। দিনে এসব কারখানা বন্ধ থাকে। চালু হয় গভীর রাতে। আর এখান থেকে বিভিন্ন হাতে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যায় প্লাস্টিক।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় মোকাম খুলনার বড়বাজার। এখান থেকে খুলনা জেলা ও এর আশেপাশের জেলাগুলোতে সিঙ্গেল প্লাস্টিকের বিভিন্ন আইটেম ছড়িয়ে পড়ছে। সেগুলো বিভিন্ন নদী-খাল হয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে।
খুলনায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সমন্বয়কারী বাবুল হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করলেও ধারাবাহিকতার অভাবে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'খুলনা অঞ্চলের এমন কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান বা সামাজিক অনুষ্ঠান নেই, যেখানে সিঙ্গেল প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস ব্যবহার করা হয় না। অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের প্লেট ব্যবহার একটি আনুষঙ্গিক ব্যাপার হয়ে গেছে। ফলে ব্যাপক হারে এটি ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায়।'
খুলনা সিটি করপোরেশনের কনজারভেন্সি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা শহরে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ থেকে ১৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ২৫-৩০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই বর্জ্যের ১০-১৫ শতাংশ সিঙ্গেল প্লাস্টিক, যার ৫৫-৬০ শতাংশ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।
এর সঙ্গে প্রায় ৫-৬ লাখ সিঙ্গেল প্লাস্টিক শপিং ব্যাগ ব্যবহারের পর অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে মিশে ড্রেন ও জলাশয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে তা উপকূলের বিভিন্ন নদী-খাল দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে।
কনজারভেন্সি বিভাগের প্রধান মো. আনিসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখন বড় মাথাব্যথার কারণ এই সিঙ্গেল প্লাস্টিক। এটি কোনোভাবেই রিসাইকেল করা যায় না। তাছাড়া চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অন্যান্য মুদি দোকানের আশপাশে এটি বিচ্ছিন্নভাবে ছড়ানো ছিটানো থাকায় আমাদের সংগ্রহ করতে বেগ পেতে হয়।'
তিনি বলেন, 'খুলনা শহরের প্রায় তিন সহস্রাধিক চায়ের দোকান ও বেকারির ব্যবহৃত সিঙ্গেল প্লাস্টিক পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ।'
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০২০ সালে এসে ৯ কেজি হয়েছে, যা ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। এসব প্লাস্টিকের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়ে। এটি সমুদ্রের জীব-বৈচিত্র্যের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খুলনা অঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে সিঙ্গেল প্লাস্টিক সুন্দরবন হয়ে সাগরে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে যশোরের নোয়াপাড়া, খুলনার বড়বাজার, চালনা বাজার, বাগেরহাটের দিগরাজ, মংলা এসব এলাকার সিঙ্গেল প্লাস্টিক ভৈরব ও পশুর নদীর মাধ্যমে সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে চলে যাচ্ছে। এর প্রভাব খুবই মারাত্মক। এসব প্লাস্টিক পণ্য উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাণ প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। এগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগ ছাড়া এটি কোনোভাবে রোধ করা সম্ভব না।'
এ প্রসঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে বর্তমানে ৫৫ মাইক্রন পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন রয়েছে, তবে বাস্তবায়ন নেই। সেজন্য জরুরিভিত্তিতে "পরিবেশ সুরক্ষা পুলিশ ফোর্স" গঠন করে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে প্রণীত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন দরকার।'
'পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো যদি উদ্যোগী না হয় তাহলে পরিবেশের যা যা বিপর্যয় তা হবেই,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'কোস্টাল অঞ্চলের প্রথম ও প্রধান সমস্যা হচ্ছে মাছের শরীরে প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। এই মাছ সাধারণ মানুষ খাচ্ছে। মাছের মাধ্যমে এই প্লাস্টিক খাদ্য-শৃঙ্খলে মানুষের মধ্যে চলে আসছে। ফলে মাছের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি মাছের প্রজনন স্বাস্থ্যের ও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ প্লাস্টিক যখন মাছের শরীরে প্রবেশ করে তখন স্বাভাবিকভাবে তার জীবন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের পরিবর্তন আসে। এর ফলে মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া, মাছের বংশবৃদ্ধি, মাছের গ্রোথ সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু মাছ না, অন্যান্য যে জলজ প্রাণী আছে সবার ক্ষেত্রে একই বিপর্যয় হচ্ছে। ফলে সুন্দরবনসহ এর আশেপাশে সব প্রাণ-প্রকৃতির মধ্যেই কিন্তু একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
সুন্দরবনে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মহসিন হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ট্যুর অপারেটরদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি যে, সুন্দরবনে সিঙ্গেল প্লাস্টিক বহন সম্পূর্ণ নিষেধ, বিশেষ করে খাওয়ার প্লেট, বোতল, বিভিন্ন প্লাস্টিক মোড়ক বহন সম্পূর্ণ নিষেধ। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জে প্লাস্টিক প্লেট ব্যবহার করার জন্য একটি ট্রলারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।'
'সাতক্ষীরায় একটি স্ট্যান্ডার্ড ফলো করা হচ্ছে। সেটা হলো—টুর অপারেটরদের প্রত্যেকটি ট্রলারে একজন করে "ইকো গাইড" দেওয়া হচ্ছে। তারা টুরিস্টদের সঙ্গে থাকছেন এবং যেন সুন্দরবনের ভ্রমণের সময় প্লাস্টিক পণ্য তারা ব্যবহার না করেন এবং পানিতে না ফেলেন সে বিষয়ে কাজ করছেন। এটি ধীরে ধীরে অন্য সুন্দরবনের অন্যান্য অংশে করতে পারলে আরও ভালো হবে,' বলেন তিনি।
এই বন কর্মকর্তা আরও বলেন, 'উজান থেকে যেসব প্লাস্টিক বর্জ্য নেমে আসে সুন্দরবনে, সেগুলো রোধ করা দরকার। আমরা দেখেছি বিভিন্ন বাজার থেকে ময়লা ফেলা হচ্ছে নদীতে, সেগুলো ধীরে ধীরে সুন্দরবনে চলে আসছে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার কমিটি, খুলনা সিটি করপোরেশন, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।'
এর আগে, গত বছর ২৯ মার্চ এডিপি অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. সাহাব উদ্দিন সুন্দরবনে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেন।
Comments