শিশুর এডিনয়েডের সমস্যা কীভাবে বুঝবেন, কখন অস্ত্রোপচার করবেন  

শিশুর এডিনয়েডের সমস্যা
ছবি: সংগৃহীত

শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য তার এডিনয়েডের সমস্যা আছে কি না জানা জরুরি।  এডিনয়েড কী এবং কখন অস্ত্রোপচার করবেন জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড-নেক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাসানুল হক নিপুনের কাছ থেকে।

শিশুর এডিনয়েড কী ও কেন হয়

ডা. হাসানুল হক বলেন, এডিনয়েড হচ্ছে এক ধরনের লিম্ফয়েড টিস্যু বা লসিকা গ্রন্থি, যেটা সব শিশুরই থাকে। শিশু এডিনয়েড নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ২ বছর পর্যন্ত এডিনয়েড স্বাভাবিক থাকে। ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত এডিনয়েড ধীরে ধীরে একটু বড় হয়। আবার ৭ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত এডিনয়েড সর্বোচ্চ আকৃতিতে পৌঁছে। ৯ বছর বয়স থেকে এডিনয়েড ছোট হতে থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। ১২-১৩ বছরেও এডিনয়েড থাকে, তবে সেটি সংখ্যায় খুব কম।

গঠনগত দিক থেকে এডিনয়েড ও টনসিলের গঠন এবং কার্যকারিতা একই রকম। শ্বাস-প্রশ্বাস অথবা খাবারের সময় বিভিন্ন রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, তা ধ্বংস করে দেয় এডিনয়েড ও টনসিল।

এডিনয়েড থাকে নাকের একদম পেছনের অংশে। নাক ও গলার সংযোগস্থলে যে নরম তালু আছে তার ওপরে এডিনয়েড থাকে। এটি খালি চোখে দেখা যায় না, এক্সরে  বা ন্যাজোঅন্ডোস্কোপের সাহায্যে দেখতে হয়। সব শিশুদের এডিনয়েড থাকে, এটি কোনো সমস্যা না। কিন্তু ঘন ঘন ঠান্ডা-জ্বরের কারণে, সর্দির কারণে, অ্যালার্জিজনিত কারণে শিশুর এডিনয়েডে যখন বার বার ইনফেকশন হয় তখন এডিনয়েড স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। আর এডিনয়েড বড় হয়ে যখন বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে তখন সেটি শিশুর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শিশুর এডিনয়েড আছে কীভাবে বুঝবেন

ডা. হাসানুল হক বলেন, শিশুর এডিনয়েড গ্রন্থি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হলে তাদের চেহারায় এক ধরনের পরিবর্তন আসে বা ছাপ দেখা যায়। যেটাকে এডিনয়েড ফেসিস বলা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন-

শিশু মুখ হাঁ করে শ্বাস নেবে, নাক দিয়ে শ্বাস নিতে পারবে না। দীর্ঘদিন মুখ হাঁ করে শ্বাস নেওয়ার কারণে শিশুর সামনের পাটির দাঁত স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু থাকবে। মাড়ি নরম হয়ে যাবে। মুখ দিয়ে লালা পড়বে। দীর্ঘদিন শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার কারণে নাকের ছিদ্রগুলো ছোট হয়ে আসবে। মুখের ভেতর বিষণ্ণ ভাব চলে আসবে, ভাবলেশহীন দেখাবে। মুখমণ্ডলের এই পরিবর্তনকে এডনিয়েড ফেসিস বলা হয়। এ ছাড়া শিশুর ঘন ঘন ঠান্ডা লাগার কারণে কানে ব্যথা হয়, কানে কম শোনে, কান পাকে ও কান দিয়ে পানি পড়ে।

এডিনয়েডের সমস্যা

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এডিনয়েড গ্রেড ১ থেকে গ্রেড ৪ পর্যন্ত গ্রেডিং করা হয়।

গ্রেড ১ হলো অ্যাডিনয়েডস নাকের পেছনে ২৫% ব্লক,

গ্রেড ২ হলো ২৫%-৫০% ব্লক,

গ্রেড ৩ হলো ৫০%- ৭৫% এবং

গ্রেড ৪ হলো ৭৫% থেকে নাকের পেছনে সম্পূর্ণ ব্লক।

ডা. হাসানুল হক বলেন, এডিনয়েড ৫০% এর বেশি হলে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়। যেমন-

১. শিশু যখন ঘুমাবে তখন হাঁ করে শ্বাস নেবে, নাক দিয়ে শ্বাস নিতে পারবে না, মুখে গড়গড়, গোঙানির মত শব্দ হবে। অনেকটা নাক ডাকার মতো শব্দ হবে।

২. কিছুক্ষণ পর পর ঘুম থেকে উঠে যাবে। ঠিকমতো ঘুমাতে পারবে না। ঘুমের মধ্যে ১০ থেকে ২০ সেকেন্ড বা কিছু সময়ের জন্য শ্বাস একদম বন্ধ হয়ে যাবে, এটাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়।

৩. এই ধরনের শিশুদের ঘনঘন সর্দি কাশি হবে, একবার সর্দি কাশি শুরু হলে সহজে সুস্থ হয় না।

৪. এডিনয়েড বড় হয়ে যাওয়ার কারণে ঘনঘন কানে ব্যথা হবে, বিভিন্ন ইনফেকশন হবে কানে, কানের পর্দা ফেটে কান দিয়ে পানি পড়বে, অনেক সময় কানের ভেতর পানি জমে গ্লু ইয়ার তৈরি করে। নাকের সঙ্গে কানের সংযোগের জন্য ইউস্টেশিয়ান নামক একটা টিউব আছে। এডিনয়েড স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে গেলে এই টিউবের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এডিনয়েডে ঘনঘন ইনফেকশনের কারণে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এর ফলে ইউস্টেশিয়ান টিউবে প্রদাহ হয়ে তা বন্ধ হয়ে যায় ফলে এসব সমস্যা হয়।

৫. এডিনয়েডের কারণে শিশু ঘনঘন মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। সেজন্য গলায় ইনফেকশন হতে পারে, গলার স্বর বসে যেতে পারে, খুসখুসে কাশি হতে পারে।

৬. অনেকের আবার এডিনয়েডের ইনফেকশনের সঙ্গে টনসিলেও ইনফেকশন হয়।

৭. এডিনয়েড বড় হলে শিশুর শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে সবসময় ঘুম ঘুম ভাব থাকে, পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে, বুদ্ধিমত্তা কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।

৮. মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হয়। যে কারণে খাবার খেতে চায় না, খাবার খেতে অসুবিধা হয়। শিশুর ওজন কমতে থাকে ধীরে ধীরে।

৯. অনেক শিশু বড় হয়ে যাওয়ার পরেও রাতে বিছানায় প্রস্রাব করার প্রবণতা থাকে।

এডিনয়েড চিকিৎসা, কখন অস্ত্রোপচার করবেন

ডা. হাসাসুল হক বলেন, শিশুর সমস্যা ও উপসর্গ দেখে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে হবে শিশুর এডিনয়েড আছে কি না। এডিনয়েড কোন গ্রেডে আছে সেটিও দেখতে হবে। বয়সভেদে বিভিন্ন ধরনের নাকের ড্রপ বা স্প্রে এবং অ্যান্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে।

এরপর নিয়মিত ওষুধ এবং ফলোআপ চিকিৎসার মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয় এডিনয়েড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে কি না। চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকের এডিনয়েড নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

যদি দেখা যায় ওষুধে কাজ করছে না, এডিনয়েডের সঙ্গে শিশুর কানে সমস্যা আছে তাদের অস্ত্রোপচার করতে হয়। এডিনয়েড সার্জারির সঙ্গে কানে পানি জমা থাকলে সেটিও সার্জারি করে বের করতে হয়। অনেক সময় ওষুধের মাধ্যমে কানের সমস্যা সমাধান করা যায়। ৮০% শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের এডিনয়েড আছে তাদের টনসিলেরও সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় দুটোই সার্জারি করে ফেলে দিতে হয়। তবে অস্ত্রোপচারের জন্য যেসব চিহ্ন থাকা জরুরি শুধু সেসব থাকলেই অস্ত্রোপচারে যেতে হবে।

শিশুর সঠিক যত্নের মাধ্যমে এডিনয়েড ইনফেকশনের হার কমানো সম্ভব। শিশু যাতে ধুলোবালি, স্যাঁতস্যাঁতে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে আইসক্রিম বা ঠান্ডা জাতীয় খাবার না খাওয়ানো, শিশুর যাতে ঠান্ডা না লাগে সেদিকে যত্নশীল হতে হবে। সর্দি কাশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

1h ago