শিশুর অতিরিক্ত কান্নার কারণ কী, যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
শিশুর অতিরিক্ত কান্না বাবা-মায়ের জন্য অত্যন্ত চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন কারণে শিশু কাঁদে। কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন হলে অতিরিক্ত কান্না অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।
শিশুর অতিরিক্ত কান্নার কারণ ও সমাধান সম্পর্কে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা আহমেদ।
শিশুর অতিরিক্ত কান্নার কারণ
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, একদম ছোট শিশুদের ভাষাই কান্না। ওরা কথা বলতে পারে না। তাই কেন কাঁদছে সেটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ফাংশনাল ও অর্গানিক কারণে শিশু অতিরিক্ত কান্না করে।
ফাংশনাল কারণ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুর অতিরিক্ত কান্নার নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এটাকে ফাংশনাল কারণ বলা হয়। ৯৫ শতাংশ কান্নাই ফাংশনাল কারণে হয়। যেমন-
১. শিশুর অতিরিক্ত কান্নার প্রথম কারণই ক্ষুধার্ত থাকা। বেশি ক্ষুধা লাগলে শিশু কাঁদে।
২. যদি ঘুম পায় তখনও শিশুরা কাঁদে।
৩. অনেক সময় শিশুদের যদি অতিরিক্ত খাবার খাইয়ে ফেলা হয় এবং সেটার জন্য পেট ফুলে অস্বস্তি লাগে সেই কারণেও অতিরিক্ত কাঁদতে পারে।
৪. শিশু ক্লান্ত থাকলে কাঁদে।
৫. শিশু যদি ভেজা থাকে, যেমন- প্রস্রাব, পায়খানা হয়ে ডায়াপার ভিজে থাকে ওই কারণে কাঁদতে পারে।
৬. যে কোনো কারণে শিশু অস্বস্তি অনুভব করলে কান্না করে। যেমন- বেশি শীত বা বেশি গরম লাগলে কান্না করতে পারে।
৭. পেট ব্যথার জন্য কাঁদতে পারে।
৮. অনেক শিশু হতাশা থেকেও কাঁদে। তাকে খেয়াল করা হচ্ছে না, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না এই কারণে কাঁদে। অর্থাৎ মনোযোগ পাওয়ার জন্য কাঁদে।
৯. অনেক সময় কোলে উঠার জন্য কাঁদে। ছোট শিশুদের শুইয়ে রাখা হলে দেখা যায় কান্না করছে, কিন্তু কী কারণে বোঝা যাচ্ছে না। আসলে কোলে উঠার জন্য কাঁদছে।
১০. শিশু রেগে গেলে কাঁদে, মন খারাপ হলেও কাঁদে।
কোনো শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াই এসব কারণে শিশুরা কাঁদে।
তবে ফাংশনাল কারণে শিশুর অতিরিক্ত কান্নার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইনফ্যান্টাইল কোলিক। এটি একটি সিনড্রোম।
ইনফ্যান্টাইল কোলিক কী
ডা. সানজিদ আহমেদ বলেন, শিশুর অতিরিক্ত কান্নায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইনফ্যান্টাইল কোলিক। এক্ষেত্রে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ বয়স থেকেই দেখা যায় বিকেল হলেই শিশু কান্না শুরু করে দেয়, তাকে থামানো যায় না।
কান্নাকে কখন ইনফ্যান্টাইল কোলিক বলা যাবে এই প্রসঙ্গে ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন-
১. শিশু একবার কান্না শুরু করলে একটানা ৩ ঘণ্টার বেশি কাঁদে
২. সপ্তাহে ৩ দিন বা তার বেশি এভাবে কাঁদে
৩. এক টানা ৩ সপ্তাহ এমন চলে
৪. প্রতিদিন বিকেলে অথবা রাতে কান্না শুরু করে
৫. কোনভাবেই থামানো যায় না, একটানা কাঁদতে থাকে
এরকম যদি হয় তখন সেটিকে ইনফ্যান্টাইল কোলিক বলা হয়। শিশুর অতিরিক্ত কান্নার এটিও একটি কারণ।
ইনফ্যান্টাইল কোলিকে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহে কান্না শুরু হয়। পিক এইজ হচ্ছে ৬ সপ্তাহ বয়স। শিশু ৩ মাস বয়স পর্যন্ত অতিরিক্ত কান্না করে। কিছু কিছু শিশু ৬ মাস পর্যন্তও করে। তবে অধিকাংশ শিশুর অতিরিক্ত কান্না ৩ মাস বয়সেই কমে যায়।
ইনফ্যান্টাইল কোলিক কেন হয়
১. শিশুর খাদ্যনালী ইম্যাচিউর থাকলে, খাবার হজম হতে সমস্যা হলে অনেক সময় পেট ফুলে যায়।
২. দুধে, মিল্ক প্রোটিনে অ্যালার্জি থাকতে পারে। এটার জন্যও ইনফ্যান্টাইল কোলিক হয়।
৩. অনেক সময় শিশু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে, কিন্তু মা গরুর দুধ খাচ্ছেন বা অন্য কোনো খাবার খাচ্ছেন যাতে তার অ্যালার্জি হচ্ছে।
৪. যে শিশু ফর্মুলা খাচ্ছে তার ফর্মুলা মিল্ক প্রোটিনে অ্যালার্জি থাকতে পারে।
এসব কারণে শিশুর ইনফ্যান্টাইল কোলিক হয়।
ইনফ্যান্টাইল কোলিকে অতিরিক্ত কান্না থামানোর জন্য ওই সময় শিশুকে খুব জোরে জোরে ঝাঁকানো যাবে না। এতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হয়ে যেতে পারে, রক্তনালী ছিঁড়ে যেতে পারে অনেক সময়। অতিরিক্ত কান্না করলে শিশুকে মায়ের কাছে রাখা, কোলে নিয়ে হাঁটা, হালকা করে দোল দেওয়া, অনেক সময় পেট একটু চাপ দিয়ে উপুড় করে শুইয়ে পিঠে হাত দিয়ে দেওয়া এগুলো করা যেতে পারে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুর ইনফ্যান্টাইল কোলিক থাকে, পরে লং-টার্ম ফলোআপে দেখা যায় তাদের বিহেভিয়ার এবং ইমোশনাল ডিজঅর্ডার হয়। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সে এসে বিহেভিয়ার এবং ইমোশনাল ডিজঅর্ডার হতে পারে। যেমন- ঘুম ও খাওয়ার সমস্যা হয়, হাইপার অ্যাক্টিভ হয়, রাগী হয়, মুড ডিজঅর্ডার হয়।
অর্গানিক কারণ
শারীরিক সমস্যার জন্য শিশুর অতিরিক্ত কান্না হচ্ছে অর্গানিক কারণ। শিশুর অতিরিক্ত কান্নার ৫ শতাংশ অর্গানিক কারণ। যেসব অর্গানিক কারণে শিশু কাঁদে সেগুলো হলো-
১. জ্বর থাকলে
২. নাক বন্ধ বা ইনফেকশন হলে
৩. গলা ব্যথা থাকলে
৪. শ্বাসনালীর প্রদাহ হলে
৫. পেট ফুলে গেলে
৬. ডায়াপার র্যাশ হলে
৭. কোনো ইনজুরি বা কোনোভাবে ব্যথা পেলে শিশু কাঁদে।
শিশুর অতিরিক্ত কান্নায় কী খেয়াল রাখতে হবে ও প্রতিকার
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, অতিরিক্ত কান্নার সমস্যা বিভিন্ন বয়সের শিশু হয়, বয়স অনুযায়ী কিছু পার্থক্যও থাকে। যে শিশুরা কথা বলতে পারে না তাদের দিকে বেশি নজর দিতে হবে।
১. যখন শিশু কাঁদে তখন বাবা-মা, অভিভাবকদের খেয়াল করতে হবে শিশু ক্ষুধার্ত কি না, ভেজা অবস্থায় আছে কি না, ঘুমের কারণে কাঁদছে কি না।
২. ফাংশনাল কারণ না থাকলে শিশুকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করে খেয়াল করতে হবে।
৩. দেখতে হবে জ্বর আছে কি না। কানের ব্যথায় অনেক সময় শিশু কাঁদে। কান লাল হয়ে আছে কি না, পুঁজ পড়ে কি না দেখতে হবে।
৪. শিশুর গিলতে সমস্যা হচ্ছে কি না দেখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় খাবার দিতে গেলে শিশু কাঁদে। তার মানে গলা ব্যথা আছে।
৫. বাচ্চা যদি ল্যাথার্জিক হয়, ঘুম ঘুম ভাব থাকে, এটাও চিন্তার কারণ।
৬. বাচ্চা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে কি না সেটা খেয়াল করতে হবে।
৭. যেসব শিশু ডায়াপার পরে তাদের ডায়াপার এরিয়াতে অনেক সময় ঘা হয়ে যায়, ডায়াপার র্যাশ হয়। এগুলো খেয়াল করতে হবে।
৯. শিশুর শরীরে কোনো জায়গা ফুলে আছে কি না, রক্তক্ষরণের চিহ্ন আছে কি না দেখতে হবে।
এসব যদি দেখা যায় শিশুর মধ্যে, তাহলে বুঝতে হবে চিন্তার কারণ আছে। সেজন্য অতিরিক্ত কান্নার অবশ্যই কারণ বের করতে হবে। না হলে ঝুঁকি থাকবেই। শারীরিক অসুস্থতার কোনো চিহ্ন আছে কি না দেখতে হবে। শিশু যখন অতিরিক্ত কান্না করবে তখন অবশ্যই একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
Comments