কাউন্টির জন্য কেন বিশ্বকাপ ছেড়ে দিলেন দুই ডাচ?
আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যখন খেলতে নামবে নেদারল্যান্ডস, আগের আসরে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ম্যাচসেরা হওয়া কলিন আকারম্যান তখন বসে থাকবেন ইংল্যান্ডে। এক ঘণ্টার বেশি অবশ্য চাইলেও নিউইয়র্কের মাঠে গড়ানো সে ম্যাচে চোখ রাখতে পারবেন না তিনি। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা খানেক পরই যে তাকে নেমে যেতে হবে ভাইটালিটি ব্লাষ্টে খেলতে। ৮ জুন- একই দিনে নেদারল্যান্ডস খেলবে, আকারম্যানও খেলবেন, কিন্তু কমলা রঙে নয়।
বিশ্বকাপের মঞ্চে ডাচরা খেলবে, আকারম্যান দূরে বসে তা দেখবেন। বিশ্বকাপে যখন ব্যস্ত থাকবেন তার সতীর্থরা, তার মনোযোগ থাকবে ডারহামকে ঘিরে। অথচ চাইলেই নেদারল্যান্ডস দলের এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ধরতে পারতেন যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যারিবিয়ানের বিমান। কিন্তু কাউন্টির হয়ে খেলতেই বিশ্বকাপকে 'না' করে দিয়েছিলেন।
২০২২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নেদারল্যান্ডসের ১৩ রানের ঐতিহাসিক জয়ে ২৬ বলে ৪১ রান করে হয়েছিলেন তিনি ম্যাচসেরা। সে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে অবদান রেখেছিল আরেকটি ক্যাচ। শর্ট ফাইন লেগ থেকে পেছন ছুটে ঝাঁপিয়ে নেওয়া রোলফ ফন দার মারওয়ের ক্যাচটা মনে আছে নিশ্চয়ই! আরেকবার প্রোটিয়াদের বিপক্ষে বিশ্বকাপের মঞ্চে ডাচরা যেসময় নামবে, আকারম্যানের সঙ্গে পাবে না মারওয়েকেও। আকারম্যানের মতো তার কারণও একই।
অথচ বিশ্বকাপে পা রাখতেই তাদের কম ঝক্কি পোহাতে হয় না! গত বিশ্বকাপে সেরা আটে থাকায় সরাসরি এবার জায়গা পেয়েছিল নেদারল্যান্ডস। তবে যেখানে বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসতে হয় সহযোগী সদস্যদের, বিশ্বকাপের অংশ হতে পারাই তাদের জন্য মাহাত্ম্য রাখে অনেক। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপে পাওয়া প্রাইজমানিটাও তাদের বাস্তবতায় বিশাল জরুরি। আর খেলোয়াড়দের তো বিশ্বকাপ জয় পরে, খেলাটাই স্বপ্ন থাকে। তাহলে কেন আকারম্যান ও মারওয়ে সেই সুযোগ হাতে পেয়েও ফেলে দিলেন? তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ, সেটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা মিলে তাদেরই সতীর্থ পল ফন মিকেরেনের কথায়।
'দিনশেষে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কে আমার বিল পরিশোধ করবে? কীভাবে পেশাদার ক্রিকেট আমি যত দিন পারি চালিয়ে যেতে পারব? এবং উত্তর হচ্ছে কাউন্টি ক্রিকেট। এটাই টেবিলে খাবার আনে।', ইএসপিএনক্রিকইনফোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ডাচদের হয়ে ৬০টি টি-টোয়েন্টি খেলা মিকেরেন।
দেশ না কাউন্টি- গত বছরের জুনেও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল নেদারল্যান্ডস। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার পর্ব চলছিল জিম্বাবুয়েতে। যেখানে তাদের মূল একাদশের গুরুত্বপূর্ণ চারজন- মারওয়ে, আকারম্যান, মিকেরেন ও ফ্রেড ক্লাসেন- সবাই কাউন্টি ক্রিকেটকেই বেছে নিয়েছিলেন। অথচ নেদারল্যান্ডসে জন্ম ও বেড়ে উঠা মিকেরেনের দেশকে বিশ্বকাপের মঞ্চে নিয়ে যাওয়াটাই স্বপ্ন ছিল।
কিন্তু তিনি তখন বলেছিলেন, 'আপনি পিতা-মাতার উপর নির্ভর করে সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারবেন না। আপনাকে ভাড়া দিতে হবে, এবং দিনশেষে আমার বিল পরিশোধ করা প্রয়োজন। আমি সেটা করতে পারি গ্লষ্টারশায়ার থেকে, এবং এই মুহূর্তে নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট বোর্ড আসলে তার (কাউন্টি চুক্তির) ধারেকাছে আসে না।' কাউন্টি ক্রিকেটের চুক্তি এতটাই মূল্যবান তার কিংবা তাদের কাছে- মিকেরেন তো বলেছিলেন, দেশের হয়ে অবসর নিতেও তার আপত্তি থাকবে না।
মিকেরেনের কথাগুলোতে যে ভাব ফুটে উঠে, সেটা কাউন্টি ক্রিকেটকে বেছে নেওয়া সকলের সঙ্গেই মিলবে। সহযোগী দেশের দৃশ্যপটে সংখ্যাটা কম নয়। ওই চারজনের সঙ্গে আরও তিনজন- ব্রেন্ডন গ্লোভার, টিম ফন দার গুগটেন ও শেন স্ন্যাটার। নেদারল্যান্ডসের সাতজন ওই বাছাইপর্বের সময় দেশের বদলে খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে।
একই সময়ে স্কটল্যান্ডের জশ ডেভি, মাইকেল জোনস, ব্র্যাড কারিরাও ছিলেন কাউন্টিতেই ব্যস্ত। এবং এমন ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালের কোয়ালিফায়ারেই যেমন দেখা গিয়েছিল তা। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া দলে চুক্তিবদ্ধ থাকায় নেদারল্যান্ডসের টম কুপার খেলতে পারেননি ২০১৯ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। তার সঙ্গে আরও দুই ডাচ- মাইকেল রিপন ও লোগান ফন বিক ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে। স্কটল্যান্ডের জশ ডেভি তখনও ছিলেন কাউন্টিতে।
এসব ক্রিকেটাররা নিজ বোর্ডের চুক্তির অর্থে তাহলে অখুশি, সে কারণেই তৈরি হল এমন পরিস্থিতি ? টাকা কম বেশি পরের কথা, চুক্তিই তো পান হাতেগোনা কয়েকজন। নেদারল্যান্ডসের যেমন ২০১৮ সালের ওই সময় মাত্র পাঁচজন ছিলেন বোর্ডের বেতনভুক্ত। সংখ্যাটা ২০২৪ সালে এসেও আটের বেশি হয়নি। অথচ সন্তোষজনক চুক্তি দিতে পারলেই নিজের খেলোয়াড়দের হারাতে হতো না তাদের। স্কটল্যান্ডের মার্ক ওয়াট সে কথাই বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, 'যতক্ষণ না আমরা আয়ারল্যান্ডের মতো দেশ হচ্ছি- যেখানে তারা কাউন্টি খেলোয়াড় যারা, তাদেরও খেলানোর জন্য চুক্তি দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। ততদিন স্কটল্যান্ডের আগে কাউন্টি, এটা এরকমই হতে থাকবে। মানুষজনের পরিবার আছে।'
আর্থিক দিক দিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে, সহযোগী দেশের ক্রিকেট বোর্ড পূর্ণ সদস্য দেশের ঘরোয়া দলের থেকেই অনেক সময় পিছিয়ে থাকে। ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট বোর্ডের বার্ষিক বাজেট ছিল ১.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। তাদের ক্রিকেটার টম কুপার অস্ট্রেলিয়ার যে ঘরোয়া দলের হয়ে খেলতেন, সেই সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ওই বছরের বাজেট ছিল ৩৩ মিলিয়ন। এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের ক্রিকেটারদেরই ধরে রাখতে পারছে না দেশগুলো- এই যখন অবস্থা, সমাধানের বেলায় সেই আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর কথাই আসবে। কিন্তু তা তো বাড়ছে বৈ কমছে!
আইসিসির ২০২৪-২৭ চক্রে দেখা যাচ্ছে, সহযোগী দেশের জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ মাত্র ১১.৮৯%। বার্ষিক আয় ৬০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের মধ্যে সহযোগী ৯৪টি দেশের জন্য থাকবে ৬৭.১৬ মিলিয়ন, আর ১২ পূর্ণ সদস্য মিলেই পাবে ৫৩২.৮৪ মিলিয়ন। যার মধ্যে আবার ২৩১ মিলিয়নই থাকবে এক ভারতের জন্য। পাকিস্তান এই মডেলের বিরোধিতা করেছিল। তবে আয়ের অধিকাংশ ভারতের মাধ্যমেই আসে বলে ইংল্যান্ডের সিইও রিচার্ড গোল্ড সহমত প্রকাশ করেছিলেন সেসময়।
অথচ এর আগের চক্রে (২০১৬-২০২৩) ১৩.৫১% বরাদ্দ ছিল সহযোগী দেশের জন্য। অর্থের পরিমাণ বাড়লেও ভাগের পরিমাণ বাড়ার চেয়ে উল্টো কমছে। আইসিসির চিফ এক্সিকিউটিভ কমিটিতে যে তিনজন সহযোগী দেশের সদস্য আছেন, তাদের মধ্যে একজন সুমোদ দামুদার খোলাখুলি বলেছিলেন, তাদের প্রয়োজন মেটাবে না চলমান চক্রের অর্থের বণ্টন। যদিও তাদের মতামতে আসলে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না! আর পরিস্থিতি না বদলালে আকারম্যান কিংবা মারওয়েতেই শেষ হয়ে যাবে না, বিশ্বকাপ বঞ্চিত হওয়াদের তালিকা লম্বা হবেই।
পূর্ণ সদস্যের অর্থ থেকেও সমস্যা, তাদের 'আরও আয়' করতে ইচ্ছুক ক্রিকেটারদের তারা পারছে না ধরে রাখতে। সেখানে সহযোগী দেশের কষ্ট, নিজের ক্রিকেটারদের চাইলেই চুক্তিবদ্ধ করতে পারছেন না। আর আকারম্যান কিংবা মারওয়ের কেমন লাগবে, সুযোগ পেয়েও বিশ্বকাপ না খেলার দুঃখ আন্দাজ করতে পারেন।
Comments