কেমন আছেন সিঙ্গেল মাদাররা?
মফস্বলের একটি বেসরকারি কলেজে পড়ান প্রভা সরকার। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কিশোর ছেলের সঙ্গে খুনসুটি-আড্ডায় জীবন ভালোই কেটে যাচ্ছে তার। কিন্তু মাঝেসাঝে পাড়া-পড়শির কটাক্ষের সম্মুখীন হতে হয় একটি অদ্ভুত কারণে। ছেলেটির বাবাকে দেখা যায় না কেন?
ছেলের বাবার সঙ্গে যে ছেলে অনেক ছোট থাকতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, এ বিষয়ে নিজের ব্যক্তিগত আলাপের পসরা খুলে বসতে স্বচ্ছন্দ নন প্রভা। তাই এড়িয়ে যান এসব কথা। তবে মনের মধ্যে বাড়তে থাকা তিতকুটে স্বাদটা প্রায়ই পেয়ে বসে। সত্যিই কি, শুধু মায়ের পরিচয়ে বড় হতে পারবে না শিশু? তার বা তার সন্তানের জন্য বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও বন্ধুদের আড্ডায়, পাড়ায়, স্কুলে– সবখানেই তাদের দুজনকে খেসারত দিতে হয় স্বামী বা বাবা না থাকার।
সবটা সামলে নিচ্ছেন, কিন্তু সামলে নেওয়ার মতো যোগ্য তাকে সমাজ ভাবছে না। এত আধুনিকতার পরও আমাদের এই পিছিয়ে থাকা মানসিকতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ ছাড়া প্রভাদের কাছে আর কোনো উপায় থাকে না।
'মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা যে নেই, এই বিষয়টি জোর করে আমার সন্তানের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চায় সমাজ', বলেন তিনি।
একটি সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য বাবা-মা দুজনেরই সমান দায়িত্ব পালন করতে হয়, অন্তত করা উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে মাতৃত্বের ধারণাকে সবসময় এতটাই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হয় যে বাবা উপস্থিত থাকলেও সন্তানের বেশিরভাগ দায়িত্ব জন্মদানের পর থেকে মাকেই পালন করতে হয়। তবু যারা প্রভার মতো 'সিঙ্গেল মাদার' তকমা পাচ্ছেন, তাদের জন্য এদিক-ওদিক থেকে হরহামেশা ছুটে আসে নানা বাক্যবাণ।
'একা বাচ্চা মানুষ করতে পারবে তো?' 'মেয়ে মানুষ কি ঘরে-বাইরে দুই সামলাতে পারে?' 'একজন পুরুষের দরকার, বুঝলে তো!'
ছোটবেলা থেকেই যেহেতু আমাদের নারীদের মানসিকতায় পুরুষের উপর নির্ভরতার বিষয়টি গেঁথে দেওয়ার জন্য সমাজ, পরিবার ইত্যাদি মরিয়া হয়ে থাকে, সেহেতু বেড়ে ওঠার পর বহু নারীর কাছেও এমনটাই স্বাভাবিক মনে হয়।
সিঙ্গেল মাদার হওয়ার প্রেক্ষাপট ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। কারো নিজের ইচ্ছা, কারো জন্য তা বাধ্যবাধকতা। নিজের ইচ্ছায় যারা এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের আত্মবিশ্বাস যতটা পোক্ত হবে, একথা বলাই বাহুল্য যে বাধ্য হওয়া মায়েদের ক্ষেত্রে সেটা হবে না। তাদের জন্য পুরোটা যাত্রাই পঙ্কিল এবং ভারসাম্য ধরতে গিয়ে পিছলে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তবু হয়তো সামলে ওঠা যায়, যদি না আশপাশের মানুষ দিনরাত সিঙ্গেল মাদেরকে অহেতুক প্রশ্নের মধ্যে ফেলে রাখে।
এনজিওকর্মী বুশরা আক্তারের ক্ষেত্রেও তাই।
তার দুটো বাচ্চাই খুব ছোট ছিল যখন তাদের বাবা মারা যান। এখন বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। সেভাবে অর্থ-সম্পদও রেখে যাননি, তাই একেবারে শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়েছে বুশরার। নিজের যোগ্যতা বা সন্তান পালন নিয়ে কোনো অপ্রাপ্তি নেই তার, কিন্তু আছে অন্যদের।
তিনি বলেন, 'প্রথম প্রথম সব একসঙ্গে ম্যানেজ করতে ঝামেলা হতো। স্বামী হারানোর দুঃখটাও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু সন্তানদের জন্য আমি আমারটা সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করেছি। কারো অভাব যাতে বোধ না করে, কোনো বিষয়ে যাতে পিছিয়ে না থাকে, তার খেয়াল রেখেছি। তবু ভাবতে খারাপ লাগে যে আমার শ্বশুড়বাড়ির আত্মীয়রা আমাকে সাহায্য তো করেনই না বরং প্রায় সময়ই আমার বাচ্চা পালার পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, আমাকে দিয়ে হচ্ছে না। ওদের বাবা বেঁচে থাকলে এভাবে কেউ বলতে সাহস পেত না। আমি যতই করি, মানুষ আমাকে বুঝিয়ে দেবে যে আমাকে দিয়ে হচ্ছে না।'
আমাদের দেশে সিঙ্গেল মাদারদের মোটা দাগে দুই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, একইসঙ্গে ক্যারিয়ার ও সন্তানের দেখভালের পুরোটা দায়িত্ব থাকে তার একার উপর। সাহায্যের জন্য মানুষ থাকলেও সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়টায় চোখে চোখে রাখতে পারেন না বলে অনেকেই ভোগেন অপরাধবোধে। ভারসাম্য ধরে রাখার চিন্তায় তারা এতটাই জটিলতার মধ্যে থাকেন যে সহজ-সরল আনন্দগুলো একসময় তাদের জন্য বিলাসিতায় রূপ নেয়। দ্বিতীয়ত, এই মায়েদের জন্য পাশ্চাত্যের জীবনটা হয়তো আলাদা, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ– বিশেষত বাংলাদেশে একজন সিঙ্গেল মাদারকে বাঁকা চোখেই দেখা হয়। বাধা-বিপত্তি ভরা তাদের চলার পথ। তবু পথ চলতে হয়, তবু ভালো থাকতে হয়।
তাই মা দিবসের এই উপলক্ষে সিঙ্গেল মাদাররা নিজেদেরকে খুঁজে পাওয়ার নতুন একটি যাত্রা শুরু করতে পারেন। আর সেইসঙ্গে সন্তানকে এমনভাবে বড় করে তুলতে পারেন, যারা নিজেদেরকে এবং তাদের মাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।
Comments