উত্তরা: শহরের ভেতর আরেক শহর
ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে উত্তরার দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার। অথচ রাজধানীবাসীর কাছে নারায়ণগঞ্জ যতটা দূর মনে হয় উত্তরা ততটা নয়।
এক সময় বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঢাকা ধীরে ধীরে উত্তরে সম্প্রসারিত হয়েছে। কালের বিবর্তনে তা গিয়ে ঠেকে যে লোকালয়ে তা-ই এখন 'উত্তরা' নামে পরিচিত।
দুই দশক আগেও উত্তরাকে বলা হতো 'ঢাকা থেকে একটু দূরে'। অনেকেই শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে উত্তরাকে বেছে নিতেন নিরিবিলি পরিবেশে থাকার জন্য। এই এলাকার অনুষঙ্গ গাছপালা, খোলা জায়গা, আধুনিক ডিজাইনের নতুন নতুন বাড়ি।
নব্বইয়ের দশকের আগে উত্তরায় সবুজ-জলাভূমি ও খোলা মাঠ ছাড়া ইট-কাঠ-পাথরের ঘর-বাড়ির সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। মূলত তখন থেকেই এই নির্জন শহরতলী প্রাণবন্ত আবাসিক ও বাণিজ্যিক নগরীতে পরিণত হতে শুরু করে।
কয়েক দশকের ব্যবধানে ব্যাপক জনঘনত্ব বাড়লেও উত্তরায় টিকে আছে আটটি উদ্যান ও প্রশস্ত রাস্তার পাশে লেক। নগরীর ভেতরে একটু সবুজের দেখা পেতে এগুলোই এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উত্তরাকে যে ১৮টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে, এর কোনো একটিতে হাঁটতে হাঁটতে আপনি কোনো সিনেমা বা টেলিভিশন নাটকের দৃশ্যের সঙ্গে মিল পেয়ে যেতে পাবেন। নাটক বা চলচ্চিত্রের দৃশ্যে শহরের ভেতরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরতে উত্তরার কদর আছে।
এসবের পাশাপাশি এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও আলো ঝলমলে বিপণি বিতান, পানি-বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় সুবিধা সহজেই পাওয়া যায়। এখন উত্তরা একটি শহরের মধ্যে সমৃদ্ধ শহর।
উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে পৈতৃক বাড়িতে থাকেন গৃহবধূ ফারজানা আফরিন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা এখানেই। নিজের চোখে এখানকার পরিবর্তন দেখেছি।'
'স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় নৌকায় করে উত্তরার তখনকার কেনাকাটার একমাত্র জায়গা রাজলক্ষ্মী মার্কেটে গিয়েছিলাম।'
কীভাবে তাকে প্রায়ই ঢাকার অন্যান্য এলাকায় যেতে হতো সেই গল্পও করেন তিনি।
তার ভাষ্য, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়টায় যখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম তখন কেনাকাটা করতে নিউমার্কেট বা গাউছিয়ায় যেতাম। এখন উত্তরায় সব পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তরার বাসিন্দারা পেয়েছেন আরও বেশি আধুনিক সুবিধা।
গাজীপুর, আশুলিয়া, মিরপুর, বসুন্ধরা ও মতিঝিলের সঙ্গে উত্তরার যোগাযোগ সবসময়ই ভালো ছিল। কিন্তু, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ছিল যানজটের প্রাবল্য।
সম্প্রতি উত্তরার সঙ্গে রাজধানীর অন্য অংশের যোগাযোগ সহজ করেছে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
আগে যানজটের কারণে গাড়িতে উত্তরায় যেতে অন্তত দুই ঘণ্টা হাতে রাখতে হতো। এখন মেট্রোরেলে আধা ঘণ্টায় মতিঝিল ও উত্তরার মধ্যে যাতায়াত করা যাচ্ছে।
আবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থল কারওয়ান বাজারে আসা যাচ্ছে।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শহরের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অন্যসব সুযোগ-সুবিধার কারণে থাকার জন্য উত্তরা আদর্শ। করপোরেট অফিসের জন্যও এলাকাটি উপযুক্ত। কর্মীরা এখানে বা এর আশেপাশে সহজেই থাকতে পারেন।'
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল সুবিধাও অনেক বেড়েছে।
আবাসন প্রতিষ্ঠান বি-প্রপার্টির ২০১৯ সালের জরিপে ঢাকায় বাসা ভাড়ার জন্য চাহিদার শীর্ষে ছিল উত্তরা।
আবাসন প্রতিষ্ঠান বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উত্তরায় উচ্চ থেকে মাঝারি মানের অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা বেশি। তবে গুলশান ও বারিধারায় অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদার তুলনায় তা এখনো কম।'
তিনি জানান, উত্তরায় বাড়ি তৈরির খরচ গুলশান ও বারিধারার সমান।
এখন উত্তরায় অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গফুটের দাম প্রায় ১২ হাজার টাকা। গুলশান-বারিধারায় তা ২৮ হাজার টাকা।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম মাসরুর রিয়াজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অ্যাপার্টমেন্টের দাম ও ভাড়া বিবেচনায় উত্তরাবাসীর মাথাপিছু আয় ২০ হাজার ডলারের কম নয়।'
তবে ঢাকার অন্যান্য এলাকার বাসিন্দাদের মাথাপিছু আয়ের সঠিক তথ্য নেই বলেও জানান তিনি।
'অভিজাত এলাকায় যোগ্য করদাতা খুঁজে বের করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এসব এলাকার বাসিন্দাদের ওপর সমীক্ষা চালাতে পারে,' বলে মত দেন এম মাসরুর রিয়াজ।
গুলশান- বারিধারার বাসিন্দাদের মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার ডলারের কম নয় বলে তিনি হিসাব করে দেখেছেন।
টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় মাথাপিছু আয় ছিল দুই হাজার ৪৮৫ ডলার। এর আগের অর্থবছরে ছিল তা ছিল দুই হাজার ৬৮৮ ডলার।
উত্তরায় বর্তমানে প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের একাধিক শাখা আছে। উত্তরায় ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) চারটি শাখা আছে। তাদের গ্রাহকদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই বিভিন্ন করপোরেশ প্রতিষ্ঠান বলে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
ঢাকার অন্যান্য এলাকার তুলনায় উত্তরার রাস্তা প্রশস্ত। এটি সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হওয়ায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া ও চীনের অনেক প্রবাসী উত্তরায় থাকেন। সেখানে অনেক আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে।
এখানে একাধিক বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতাল আছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম শামীম ডেইলি স্টারকে জানান, উত্তরায় তাদের দুটি শাখা আছে। প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচে ১৫০ শয্যার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কাজ শুরু হয়েছে।
উত্তরাকে আলাদা শহর হিসেবে আখ্যা দিয়ে করে তিনি বলেন, 'এখানকার বাসিন্দাদের ক্রয়ক্ষমতা ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানীর বাসিন্দাদের সমান।'
'বাড়তি চাহিদার কারণে ২০০০ সালে উত্তরায় প্রথম ল্যাবএইড ও ২০১৮ সালে এর দ্বিতীয় ইউনিট চালু হয়' উল্লেখ করে এ এম শামীম আরও বলেন, 'একবার আমাদের গুলশান শাখার এক চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিডব্যাক পেয়েছিলাম। উত্তরার এমন অনেকে ছিলেন যারা আমাদের সেবা নেওয়ার জন্য গুলশানে আসতেন। তারা বলেছিলেন, উত্তরায় শাখা থাকলে ভালো হয়।'
বিমানবন্দর থেকে উত্তরা কাছে হওয়ায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঢাকার দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলে যাচ্ছে।
রপ্তানি খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় ও কমপক্ষে ৮০০ বায়িং হাউস আছে উত্তরায়।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, আরএকে সিরামিকসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এখন উত্তরায়।
গত ২৫ বছর ধরে উত্তরায় থাকছেন একটি বায়িং হাউজের স্বত্বাধিকারী এনায়েত কবির।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উত্তরা অনেক বদলে গেছে। আগে এত মানুষ ছিল না। রাস্তা ছিল যানজটমুক্ত। তখন একমাত্র শপিংমল ছিল রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স।'
একসময় উত্তরার ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর সেক্টরে জলাবদ্ধতা থাকলেও ২০১০ সাল থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে।
এনায়েত কবির আরও বলেন, 'এখন আমাকে শুধু কারখানা পরিদর্শনের জন্য উত্তরার বাইরে যেতে হয়। তাছাড়া আমার ও পরিবারের অন্যদের যা যা প্রয়োজন সবই উত্তরায় পাওয়া যায়।'
বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান উত্তরার পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন।
আশুলিয়া, গাজীপুর ও টঙ্গীতে অনেক পোশাক কারখানা আছে। উত্তরা থেকে সেখানে যেতে খুব কম সময় লাগে। তাই উত্তরায় সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ও লিয়াজোঁ অফিস আছে।
বিজিএমইএ সভাপতি জানান, এর ফলে বিদেশিরা সহজেই কারখানায় যেতে পারেন।
তার মতে, এই পরিবর্তনের কারণে অনেক গার্মেন্টস মালিক, মার্চেন্ডাইজার ও কর্মী পরিবার নিয়ে রাজধানীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে উত্তরায় চলে এসেছেন।
Comments