যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার কিছু কি অবশিষ্ট রইলো?

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শুধু শিক্ষা দেওয়াই নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে নির্মম আচরণ করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভের চিন্তা না করে।
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ গত ১ মে 'ইহুদিবিদ্বেষ সচেতনতা আইন (Antisemitism Awareness Act)'—যা উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদনের মাধ্যমে আইনে পরিণত হতে পারে—পাস হওয়ার খবরে সুদূর বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক কেন উদ্বিগ্ন হবেন? এর সহজ উত্তর হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর (ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট) মাধ্যমে গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও উপরে উল্লিখিত আইন তা খর্ব করবে।

প্রথম সংশোধনী যতটা বলিষ্ঠভাবে যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যম এবং সব গণতান্ত্রিক দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে, এর সঙ্গে তুলনীয় আর কিছুই নেই। তাই সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হতে দেখলে বিশ্বজুড়ে আমার মতো আরও অসংখ্য সাংবাদিক উদ্বিগ্ন হন।

আজ থেকে প্রায় ২৩৩ বছর আগে ১৭৯১ সালে যারা ওই সংশোধনীর পেছনে ছিলেন, তাদের দূরদর্শিতার কথা আমি প্রায়ই ভাবি। সেই সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি হাজারো নতুন আইন পাস ও চুক্তি সম্পাদন, যুদ্ধ ও সামরিক অভিযান, দেশে দেশে সরকার পতনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু তারা একবারের জন্যও প্রথম সংশোধনীতে হাত দেয়নি।

প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অহংকারের জায়গা—যে কথা তারা গর্বের সঙ্গেই প্রচার করে। বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি এই 'স্বাধীনতার' আকর্ষণে বিশ্বের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আবাস গেড়েছেন। অথচ, ইসরায়েলের অপকর্ম নিয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য সংবিধানের ওই পবিত্র বিধানটিকে এখন হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে।

আজীবন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয়গুলোর অন্যতম হলো ম্যাগনা কার্টা (১২১৫)—যেখান থেকে আধুনিক সময়ের মানবাধিকারের ধারণার সূত্রপাত—এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী—যেখানে ধর্ম পালন, মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সবচেয়ে বলিষ্ঠ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

প্রথম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, 'কংগ্রেস এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না যা কোনো একটি ধর্মকে সমর্থন করে বা ধর্ম পালনে বাধা দেয়; অথবা বাকস্বাধীনতাকে বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে; অথবা জনগণের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের এবং অভিযোগগুলোর প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানোর অধিকারকে সীমিত করে।'

এত দিনে বিশ্বজুড়ে বহু পরিবর্তন ঘটে গেলেও মার্কিনিরা কখনো মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে আপস করেনি। যদিও গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সাজানো অভিযোগে ইরাক আক্রমণের মাধ্যমে অনেকখানি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছিল আমেরিকান সরকার ও গণমাধ্যম।

তবে, সদ্য পাস হওয়া এই 'আইন' প্রথম সংশোধনীর নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি সবচেয়ে বড় আঘাত, যা সাংবাদিক হিসেবে আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করেছে। আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের এই আইনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়ে বিশ্বের অনেক জায়গায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হবে।

মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রভাব সম্পর্কে আমরা সবাই জানি—এআইপিএসি (আমেরিকা ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার কমিটি) প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার অর্থায়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিশেষত নবাগতদের।

কিন্তু যে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অবগত ছিলাম না তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরেও তাদের অগাধ প্রভাব। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের পর এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনে নজিরবিহীন দমন-পীড়ন দেখা গেল। হার্ভার্ড ও পেনসিলভানিয়ার মতো আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টদের অপসারণের ঘটনা শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে।

শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও হাজারো শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গোমর ফাঁস হয়েছে—যেখানে ইসরায়েলের স্বার্থের শুরু, সেখানেই মত প্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতার সীমারেখা।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ৩২০ বনাম ৯১ ভোটে পাস হওয়া 'ইহুদিবিদ্বেষ সচেতনতা আইন' কেন গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি বড় হুমকি? কারণ, এতে ইহুদিবিদ্বেষের সংজ্ঞার সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং একটি লাইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, 'ইসরায়েল রাষ্ট্রকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা সামগ্রিকভাবে ইহুদি সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করার সমতুল্য'।

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী 'রাষ্ট্র'কে ধর্মের বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমতুল্য বলে ধরা হয়েছে—এ ক্ষেত্রে সম্প্রদায়টি ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের। রাষ্ট্র হচ্ছে একদল মানুষের তৈরি করা রাজনৈতিক সত্ত্বা। মানুষের মতোই রাষ্ট্রেরও বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের মতে, তাদের ধর্মীয় বিধানগুলো স্রষ্টা প্রেরিত, সেখানে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। রাষ্ট্রের ভিত্তি রাজনৈতিক আর ধর্মের ভিত্তি নৈতিকতা। রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন ও ধরে রাখার চর্চা প্রচলিত। অপরদিকে ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব ও আনুগত্য নিশ্চিত করা হয়। কাজেই রাষ্ট্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকলেও ধর্মের বিষয়ে সেটা সম্ভব না। কোনো রাষ্ট্রকে 'ধর্মবিশ্বাসের' মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়া, যেখানে ওই রাষ্ট্রের কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

আরও বলতে গেলে, একটি রাষ্ট্র—এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল—এমন একটি সরকার দ্বারা পরিচালিত, যে সরকার নির্বাচিত হয়েছে পর্দার আড়ালের নানান রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে, যা অনেকাংশেই নিকৃষ্ট ধরনের। নেতানিয়াহু ও তার কট্টর ডানপন্থী সরকার নির্বিচারে গণহত্যার মাধ্যমে গাজাকে জনশূন্য করার এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের নীতি অবলম্বন করছে। সেই সরকারের কাজে নিন্দা জানানো হলে সেটা কেন ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে আখ্যায়িত হবে?

যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে ছাত্র আন্দোলন চলছে তা ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। তারা ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ইসরায়েল সরকারের গণহত্যা, শিশু হত্যা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের যে নীতি, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। হঠাৎ করেই এত বড় এই বিক্ষোভ শুরু হয়নি। এই বিক্ষোভ আজ অবধি গাজায় ৩৫ হাজার নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি হত্যার বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে ১২ হাজারই শিশু। গাজায় প্রতিদিনই বোমাহামলা হচ্ছে এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে তাদের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করা হয়, যেন মানুষের জীবন একটি সংখ্যামাত্র। সম্প্রতি জাতিসংঘের সংস্থা মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (ইউএনএমএএস) হিসাব করে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২৩ লাখ মানুষের গাজা উপত্যকার বেশিরভাগ অংশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করায় এলাকাটি থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন ধ্বংসস্তূপ সরাতে হবে। এই কাজে সময় লাগবে অন্তত ১৪ বছর।

যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত, সব ধরনের মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ পরিপন্থী ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী এসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন কি তারা ইহুদিবিদ্বেষ প্রকাশ করছেন?

এখানে আরেকটি বিষয় বলার আছে। শান্তিপূর্ণ এই বিক্ষোভ মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কি পুলিশ ডেকে আনার দরকার ছিল? সবগুলোতে না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব 'ক্যাম্পাস পুলিশ' রয়েছে, যারা বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু পুলিশকে ডেকে আনা হয়েছে—যাদের মনস্তত্ব ও প্রশিক্ষণের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বল প্রয়োগ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা এবং যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের মোকাবিলা করেন। পুলিশ ডেকে আনার উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো এবং বিক্ষোভে বাধা দেওয়া, যেন তারা পরবর্তীতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আর কোনো বিক্ষোভের কথা চিন্তাও না করে।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত নির্মম। ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষকরাও হামলা থেকে রেহাই পাননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শুধু শিক্ষা দেওয়াই নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে নির্মম আচরণ করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভের চিন্তা না করে।

প্রথম সংশোধনীর সমর্থক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে, পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে সর্বজনীন মানবাধিকারে যে গীত সারাক্ষণ গাইতে থাকে, শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভের মাধ্যমে সেই অঙ্গীকারের ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করছে। মার্কিন ক্যাম্পাসের বিক্ষোভগুলোতে সেসব মূল্যবোধকে তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো আমরা সবাই আমাদের সমাজে পেতে চাই। তাদেরকে আক্রমণ করা, তাদেরকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে অসম্মান করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার ও আটক করার ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির মতো শিক্ষাঙ্গনেও এখন সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি আধিপত্য চলছে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago