বর্তমান গতিতে তুলা চাষে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে লাগবে ১৭০ বছর

তুলা চাষ
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) কর্মকর্তারা দেশীয় তুলা উৎপাদনে ধীরগতির জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা, জনবল, জমি ও তহবিলের অভাবকে দায়ী করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

পর্যাপ্ত কৃষিজমি, জনশক্তি ও সরকারি সহায়তার অভাবের পাশাপাশি উদ্ভাবন ও বিনিয়োগের স্বল্পতার কারণে দেশে তুলা চাষের সম্প্রসারণ বছরের পর বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে।

কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, চীনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো পোশাক তৈরির জন্য আমদানি করা তুলার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

দেশের ৪৫০ সুতা কারখানায় ব্যবহার করা বার্ষিক ৮৫ লাখ বেল (প্রতি বেল প্রায় ২১৮ কেজি) তুলার মাত্র চার শতাংশ তুলা দেশে উৎপাদিত হয়।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশ প্রায় ৪৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের তুলা আমদানি করেছে। একই অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি হয়েছে চার হাজার ২৬০ কোটি ডলার।

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) কর্মকর্তারা দেশীয় তুলা উৎপাদনে ধীরগতির জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা, জনবল, জমি ও তহবিলের অভাবকে দায়ী করেছেন।

সিডিবির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সাত বছরে তুলা চাষ বার্ষিক গড়ে এক শতাংশ বেড়েছে। তখন মোট জমি ছিল ৪৫ হাজার হেক্টর।

সিডিবি ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে তুলা চাষের জন্য প্রায় ১৬০ কোটি টাকা খরচ করলেও উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে চার শতাংশ।

২০২২ সালে সিডিবি ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে তুলা চাষ এক লাখ হেক্টরে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। তবে যদি তা বর্তমান গতিতে চলতে থাকে তবে সিডিবির এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরও ১৭০ বছর লাগবে।

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিডিবি নয়টি উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলা উদ্ভাবন করায় দেশের তুলা উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে।

সিডিবি ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে গবেষণায় ৩০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা খরচ করলেও দেশে তুলা উৎপাদন বেড়েছে নয় শতাংশ।

সিডিবির তিন গবেষণা কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—তহবিল ও জনবলের সীমাবদ্ধতার কারণে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।

তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিবিডি গবেষণা কেন্দ্রে অনুমোদিত ৮৮০ পদের মধ্যে ৩৪৬ পদ শূন্য ছিল।

'দেশে তুলা চাষ চরমভাবে অবহেলিত,' উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্যশস্য চাষে অনেক বেশি মনোযোগী। তাই তুলা চাষে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয় না।'

সিডিবি গবেষণা কেন্দ্রগুলোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ ও সাধারণ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ২৮ পদের বিপরীতে কর্মকর্তা আছেন আট বা নয় জন।

বান্দরবানের হিল কটন রিসার্চ সেন্টারের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মংসানু মারমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের অন্যান্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মতো সিডিবিতে দক্ষতার অভাব আছে।'

'তুলা বোর্ড মাত্র ৫০ থেকে ৬০ গবেষক দিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। তাই সরকার তুলা গবেষণাকে অগ্রাধিকার না দিলে ও এখানে বিনিয়োগ না বাড়ালে সুফল পাবো না।'

তার মতে, সিডিবি গবেষণা কেন্দ্রের শূন্য পদ পূরণের জন্য যোগ্য গবেষকদের আকৃষ্ট করতে পারলে দেশে তুলা উৎপাদন ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

যশোরে সিডিবির কটন রিসার্চ, ট্রেনিং অ্যান্ড সিড মাল্টিপ্লিক্যাশন ফার্মের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডিএমএম আবেদ আলী ডেইলি স্টারকে জানান, দুই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদসহ ১২ পদ শূন্য।

তিনি বলেন, 'আমরা যদি জনবল ঘাটতির সমাধান করতে পারি তবে আর্থিক সহায়তা আসবে। ফলে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারবো।'

দিনাজপুরের সিডিবি সেন্টারের গবেষক এ এইচ মোহাম্মদ কায়কোবাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জনবল সংকট দূর করার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়াতে নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।'

তিনি মনে করেন, 'সরকারের মূল লক্ষ্য অন্যান্য অর্থকরী ফসলের দিকে। তাই অর্থকরী ফসলের সঙ্গে তুলা যুক্ত করলে ফলন বাড়তে পারে।'

বাংলাদেশ তুলা সমিতির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ আইয়ুব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আখ চাষের অব্যবহৃত জমি ও তামাক চাষের জমি তুলা চাষের আওতায় আনলে উৎপাদন ১০-১২ শতাংশ বাড়বে।'

'দেশে তুলা চাষ চরমভাবে অবহেলিত,' উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্যশস্য চাষে অনেক বেশি মনোযোগী। তাই তুলা চাষে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয় না।'

তিনি আরও বলেন, 'দেশে তুলা উৎপাদন যদি বছরে এক কোটি বেল বাড়ানো যায়, তাহলে তুলনামূলক ব্যয়বহুল আমদানি করা তুলার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাঁচানো যাবে।'

আমদানি নির্ভরতা কমাতে ও তুলা উৎপাদন বাড়াতে প্রথমবারের মতো কৃষি মন্ত্রণালয় ১০ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে।

সিডিবির নির্বাহী পরিচালক ফখরে আলম ইবনে তবীব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার তুলা চাষিদের প্রায় ১০ কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় কৃষি মন্ত্রণালয় তুলাকে প্রাধান্য দেয়।'

'বাংলাদেশে বিপুল জনসংখ্যা ছাড়াও কৃষিজমির পরিমাণ খুবই কম। তাই সীমিত পরিমাণ জমি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যশস্যের দিকে বেশি নজর দেওয়া স্বাভাবিক। তুলা উৎপাদন বাড়াতে জন্য এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ,' যোগ করেন তিনি।

তিনি জানান, তামাক চাষের কিছু জমিকে তুলা চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এখন ঝিনাইদহ, যশোর, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কিছু অংশে তুলা চাষ হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি এস এম মান্নান কচি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তুলার গুণগত মান আমদানি করা তুলার মতো অত ভালো নয়।'

জমির সীমাবদ্ধতার কারণে তুলার উৎপাদন বাড়ানো কীভাবে চ্যালেঞ্জিং সে প্রসঙ্গে তুলে তিনি বলেন, 'কৃষি গবেষকরা একসঙ্গে কাজ করলে এ বিষয়ে সমাধান পাওয়া যেতে পারে।'

তুলা উৎপাদন কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আবদুস শহীদ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Comments

The Daily Star  | English

Indian Media Reporting on Bangladesh: Fake or Fact?"

Why is the Indian media's coverage of Bangladesh markedly different from that of Bangladeshi news outlets?

8h ago