ভিকারুননিসা স্কুল নিয়ে কেন এত বিতর্ক?

'মেয়েরা, তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও। আমি আশ্বাস দিচ্ছি, ন্যায়বিচার করা হবে। যুগে যুগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের মুখে এই কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর কত অভিযোগ শুনতে হবে?'

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অভিভাবক জয়া শহীদ নিজের ফেসবুক ওয়ালে এই পোস্ট দেওয়ার পরদিনই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম, 'বিশৃঙ্খলা থামছেই না ভিকারুননিসায়'। একই দিনের আরেকটি খবরের শিরোনাম, 'ভিকারুনিসায় যৌন হয়রানি: প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক, তদন্ত করবে উচ্চতর কমিটি'।

রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি, ভর্তি বাণিজ্য, স্কুল পরিচালনা কমিটির নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। রাজধানী ঢাকা তো বটেই, দেশের আর কোনো স্কুল এত বেশি খারাপ সংবাদের কারণে সংবাদ শিরোনাম হয় কি না সন্দেহ।

যদিও সন্তানদের এই স্কুলে পড়ানোর ব্যাপারে অভিভাবকদের আগ্রহের শেষ নেই। তার বড় কারণ এসএসসি ও এইচএসসিতে বরাবরই মেধা তালিকার শীর্ষে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। মূলত সেই বিপুল আগ্রহের সুযোগ নিয়েই এখানে বছরের পর বছর ধরে চলে ভর্তি বাণিজ্য।

সম্প্রতি একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এই প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার নিয়ে যখন সারা দেশে তোলপাড় চলছে, তখনো ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে সমালোচনা তাদের পিছু ছাড়ছে না। বয়সসীমা লঙ্ঘন করে ভর্তি করায় স্কুলের প্রথম শ্রেণির ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

নীতিমালা অনুসারে, ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারির আগে জন্ম এমন শিক্ষার্থীরা ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু মাউশি দেখেছে, ওই ১৬৯ শিক্ষার্থীর জন্ম ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এবং ভর্তির বয়সসীমার নীতি লঙ্ঘন করে তাদের ভর্তি করা হয়েছে।

খবর বলছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাউশির সঙ্গে পরামর্শ করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে লটারির মাধ্যমে বেইলি রোড, আজিমপুর, ধানমন্ডি ও বসুন্ধরা শাখায় ওই ১৬৯ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করেছে।

অভিযোগ উঠেছে, লটারির মাধ্যমে ভর্তির কথা বলা হলেও এখানে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। কেননা শিক্ষার্থী ভর্তিতে দুর্নীতি, অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগে অনিয়মসহ নানা ইস্যুতেই স্কুলটি বিতর্কিত।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালেও প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৪৪৩ অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সমালোচনার মুখে পড়ে। ওই সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কেকা রায় চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালে ৬ থেকে ৮ জানুয়ারি প্রথম শ্রেণিতে ১৬২ জনকে ভর্তি করানো হয়। পরবর্তী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে হাসিনা বেগম দায়িত্বে থাকাকালে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি করা হয় ২৮১ জন। এই দুই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষেরই ভর্তি ফরমে সই ছিল না।

অভিযোগ ছিল, গভর্নিং বডি জোর করে শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। এই অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তির বিরোধিতা করলে ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিনা বেগমের বিরুদ্ধে গভর্নিং বডি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ জানায়।

তবে এবার নতুন করে ভিকারুননিসা আলোচনায় এসেছে যৌন হয়রানির ঘটনায়। স্কুলের আজিমপুর শাখার সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়। একাধিক শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন ছাত্রী ও অভিভাবকরা।

অদ্ভুত বিষয় হলো, শিক্ষক মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে তিন ছাত্রীর আনা অভিযোগের ঘটনাগুলো এক বছর আগের হওয়ায় এবং তিনি পবিত্র হজ করার পর এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বিধায় তাকে বরখাস্ত না করে শেষবারের মতো সতর্ক করে অন্য কোনো শাখায় বদলি করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে তদন্ত কমিটি।

যদিও গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মিন্টু রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, মুরাদ হোসেনের কাছে বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

পুলিশ বলছে, স্কুলের পাশে কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের পড়ানোর নামে ভিন্ন সময়ে তাদের নানাভাবে যৌন হয়রানি করেছেন তিনি। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে শিক্ষক মুরাদের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে।

স্কুলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির। যদি কোনো শিক্ষক নৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তার বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের কাজ করার কথা কল্পনাও করতে না পারেন।

মেয়েদের স্কুলে বড় সমস্যা যৌন হয়রানির অভিযোগ অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা চেপে যায়। এর পেছনে থাকে সামাজিক ভয় ও শিক্ষকের প্রতি সম্মান। ফলে মেয়েদের স্কুলে কত সংখ্যক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে, তা জানার কোনো সুযোগ নেই।

অনেক সময় স্কুলের সুনাম রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষও বিষয়গুলো এড়িয়ে যায়। যে কারণে বড় ঘটনা না ঘটলে বিষয়গুলো জানারই সুযোগ ঘটে না। অনেক ঘটনাই আড়ালে থেকে যায়।

আবার অনেক সময় শিক্ষক রাজনীতির শিকারও হতে পারেন কেউ কেউ। ফলে ঘটনার সুষ্ঠু ও নির্মোহ তদন্ত ছাড়া প্রকৃত ঘটনা জানার সুযোগ কম। তবে এও ঠিক, যখন শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির প্রতিবাদে ক্লাসরুম ছেড়ে বাইরে এসে প্রতিবাদ জানায়, সেখানে ঘটনার সত্যতা আছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে নেওয়া উচিত। শিক্ষক রাজনীতি থাকলে সেখানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থীর ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসার কথা নয়।

শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো মূলত কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের বাসায় প্রাইভেট পড়তে গিয়ে ঘটে থাকে। কোচিং ও প্রাইভেটের পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। শিক্ষকরা ক্লাসরুমে ঠিকমতো পড়ালে কেন কোচিং বা প্রাইভেট লাগবে—সেই তর্ক বহুদিনের।

আবার যখন ক্লাসে ৫০-৬০ জন বা তারও বেশি শিক্ষার্থী থাকে, সেখানে একজন শিক্ষকের পক্ষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যাপারে নজর দেওয়া; ক্লাসের সবশেষ বেঞ্চের শিক্ষার্থীর কাছে নিজের কথা পৌঁছানো কতটা সম্ভব—তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ ক্ষেত্রে ক্লাসরুমে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম রাখা এবং ক্লাসে খুব বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি না করার প্রস্তাবও আছে।

যদিও দিন শেষে শিক্ষা যখন পণ্য ও শিক্ষকের বেতন যখন অন্য পেশার মানুষের তুলনায় অনেক কম এবং শিক্ষকতার চাকরিটাও যখন প্রশাসনও পুলিশ ও অন্য পেশার চেয়ে কম আকর্ষণীয়—তখন কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধের কথা বলা হলেও শিক্ষকের আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার। যদিও এর কোনো যুক্তিই যৌন হয়রানিকে বৈধতা দেয় না। দিতে পারে না।

বারবার যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ভর্তি বাণিজ্য, স্কুল পরিচালনা কমিটির নির্বাচন, কমিটির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের স্বার্থ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং সর্বোপরি যৌন হয়রানিসহ নানা ঘটনার কারণে গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে এবং যেসব ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে, তা শুধু ভিকারুননিসার ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং ঢাকাসহ সারা দেশে মেয়েদের স্কুলের ব্যাপার সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।

অভিভাবকদের অনেকেই এ ভেবে চিন্তিত হতেই পারেন যে, তার মেয়েটি স্কুলে আদৌ নিরাপদ কিনা। কোচিং সেন্টারে বা শিক্ষকের বাসায় পড়তে গিয়ে তার মেয়েটি কোনো ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হলো কিনা এবং মেয়েটি ভয় ও সংকোচে তা প্রিয়জনের কাছেও চেপে যাচ্ছে কি না, এ নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

এরকম পরিস্থিতিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভরসা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। তাদেরকে এই নিশ্চয়তাটুকু দিতে হবে যে—ক্লাসরুমে তো বটেই, কোচিং সেন্টার ও শিক্ষকের বাসায়ও প্রতিটি মেয়েই নিরাপদ। কিন্তু এগুলো শুধু মুখের কথা নয়। কাজে প্রমাণ করতে হবে।

যেকোনো অপরাধের ব্যাপারে রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কী, তা বোঝা যায় ওই অপরাধ বন্ধে তথা অপরাধ সংঘটিত না হওয়ার জন্য কী ধরনের আইন, নীতি, পরিকল্পনা, কার্যপদ্ধতি ও বাস্তবায়নের কৌশল আছে—তার ওপর। শুধু কঠোর আইন দিয়েও অপরাধ বন্ধ করা যায় না, যদি না ওই আইনের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ প্রয়োগ হয়।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Nationwide water transport strike disrupts cargo movement

Around 800 cargo vessels with 15 lakh tonnes of goods stranded across the country

17m ago