‘এ কেমন কপাল?’

রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনে মারা যাওয়া স্বজনদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিউলি দাস। ছবি: আনিসুর রহমান

রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম একজনের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। ততক্ষণে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জ্বলছে আগুন।

এমন কি মধ্যরাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন জানান, তিন জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং ৬৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে লাগা আগুন নিভে যাওয়ার পর আসতে থাকে আগুনের ভয়াবহতার চিত্র। যা ২০২১ সালে রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনের পর সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।

ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম যে মরদেহটি আসে সেটি একটি শিশুর।

তারপরই যেন অ্যাম্বুলেন্সে আহতদের স্রোত। যাদের নিয়ে আসা হচ্ছিল তাদের কেউ জীবিত, কারো কারো অবস্থা জীবিত না মৃত নিশ্চিত নয়, কেউ কেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

কিন্তু হাসপাতালে থাকা সবাইকে চমকে রাত দেড়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল  প্রাঙ্গণে একটি বড় সাদা কন্টেইনার ট্রাক এসে থামে। দরজা খুলতেই দেখা যায় ট্রাকভর্তি মরদেহ।

হাসপাতালের কর্মীরা সারি সারি স্ট্রেচার নিয়ে আগেই অপেক্ষা করছিলেন। স্ট্রেচারে করে তারা একে একে মৃতদেহগুলো দ্রুতগতিতে সরিয়ে নেন।

হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে প্রিয়জনের খোঁজে মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকা অসংখ্য মানুষ তাদের দিকে ছুটে আসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসেন আনসার সদস্যরা।

প্রিয়জনদের খোঁজে হাসপাতালে স্বজনদের ভিড়। ছবি: আনিসুর রহমান

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গের চিপা স্যাঁতস্যাতে দুই ঘরের মেঝেতে এক লাশ নামিয়েই আরেকটা আনতে ছুটে যাচ্ছিল স্ট্রেচারগুলো

কিছু মরদেহ ব্যাগে থাকলেও, এত এত লাশের ভিড়ে বেশিরভাগই খোলা রাখা হচ্ছিল।

একে একে দুটি ঘরই এতটা ভরে উঠছিল যে পা ফেলার পর্যন্ত জায়গা ছিল না।

ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আশরাফুল আলম বলেন, 'আমরা বিপুল সংখ্যক গুরুতর রোগীর জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়ে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু যারা হাসপাতালে আসছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মৃত।'

নিহতদের স্বজনরা তাদের প্রিয়জনকে শনাক্ত করার জন্য হুমড়ি খেয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করায় মর্গের দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

তারা মর্গের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের অনুরোধ করছিলেন একবার ভেতরে ঢুকতে দিতে, একবার দেখতে দিতে লাশের স্তুপে তাদের নিখোঁজ ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন আছে কি না।

গত তিন-চার ঘণ্টা ধরে আপনজনের খোঁজের ইতি টানছিল এই লাশঘর।

দুই মেয়েকে স্ট্রেচারে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন কবীর খান। ছবি: আনিসুর রহমান

মর্গের বাইরে নোংরা, ভেজা মেঝেতে বসে নিজের পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে নিজের মাথায় চাপড় দিচ্ছিলেন বাসনা রানী।

আদরের দুই নাতি-নাতনি সম্পূর্ণা পোদ্দার (১২) ও সান পোদ্দার (৮) আর মেয়ে পপি রায়ের লাশ দেখে নিজেকে কোনোভাবেই স্থির রাখতে পারছিলেন না বাসনা।

'এ কেমন কপাল?'

লাশগুলোর জামাকাপড়ে পোড়া দাগ আর নাক গলে বের হওয়া শুকনো রক্ত ছাড়া তারা যে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে এটি বোঝার কোনো উপায় নেই।

বেশিরভাগ মানুষই ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় মারা যান। নিচতলা থেকে শুরু হওয়া আগুন তাদের কাছে পৌঁছায়নি। কিন্তু পৌঁছাতে পারেনি উদ্ধারকারীরাও।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, দ্বিতীয় তলার কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর একটা ঘর থেকেই ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

মরদেহগুলো এতটাই অক্ষত ছিল যে আশিক আহমেদ তার ছেলে আরহানকে বাঁচাতে হাসপাতালের বাইরে তার আত্মীয়দের অনুরোধ করছিলেন এয়ার-অ্যাম্বুলেন্সে করে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে।

কিন্তু মা নাজিয়া ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আরহান আগেই মারা গিয়েছিল।

ভয়াবহ এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া প্রথিত শামস বর্ণনা করেছেন কেমন ছিল সেই আগুনের রাত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, 'আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরের সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে এবং এর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।'

একটি লজিস্টিক কোম্পানিতে কর্মরত প্রথিত ভবনের আট তলায় অ্যামব্রোসিয়া রেস্তোরাঁ ও মিউজিক ক্যাফেতে গিয়েছিলেন।

'আমি লোকজনকে লাফিয়ে পড়তে দেখেছি। এরপর যা দেখেছি তা ছিল ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। লোকজন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল, আমি তাদের সাহায্য করার জন্য কিছুই করতে পারিনি। সেই মুহূর্তে আমি ভেবেছিলাম আগুন দ্রুতই আমাদেরও কাছেও পৌঁছাবে।'

তিনি আরও লেখেন, 'আমরা প্রায় ২০ জন সেখানে আটকা পড়েছিলাম। আমরা প্রথমে শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলাম। উপায় বের করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। সিঁড়িতে আগুনে জ্বলছিল। আমাদের মেঝে কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল, আমরা প্রায় শ্বাস নিতে পারছিলাম না।'

'আমাদের মধ্যে একজন ছাদে যাওয়ার কোনো উপায় আছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কাশতে কাশতে ফিরে এসেছিল। জানায়, পুরো সিঁড়ি আগুনে জ্বলছে এবং আগুন আমাদের আরও কাছে এগিয়ে আসছে।'

প্রথিত এবং অন্যরা বারান্দায় যেতে পেরেছিলেন। সেখানে তারা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাহায্য চেয়েছিলেন।

তাদের খুঁজে পেয়ে উদ্ধার করা হয়।

অনেকের মতো কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর কর্মচারী জুয়েল গাজী ও তার ভাতিজা মোহাম্মদ রাকিব মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও ঝাঁপ দেওয়ার পথ বেছে নেন।

রাকিব বলেন, তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে থাকায় আমরা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই।

তৃতীয় তলার খানা রেস্টুরেন্টের শেফ মুজাহিদুল ইসলাম জুবায়েরও ঝাঁপ দেন।

তারা তিন জনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

 

Comments

The Daily Star  | English
 Al Bakhera killings Al Bakhera killings

Killings in Chandpur: Water transport workers go on strike

Water transport workers has started an indefinite strike from midnight

3h ago