বইমেলায় একুশের চেতনা আছে কী

ছবি: ইমরান মাহফুজ/ স্টার

বইমেলা কি মেলার রূপ হারিয়ে বই মেলায় রূপ নিচ্ছে? এই নিয়ে তর্ক, আলাপ ও প্রশ্ন করার সময় এসেছে, জরুরিও বটে। মেলা শব্দের অর্থ একাধিক। সাধারণত এবং সর্বজনের কাছে গ্রাহ্য ও পরিচিত রূপ হল এর উৎসব অর্থ। যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও বাণিজ্যিক কারণে অনেক মানুষ মিলিত হয়, তাকেই মেলা বলে। 'মেলা' বলতে উন্মীলনও বোঝায়। যেমন চোখ মেলো, অর্থাৎ তাকাও-উন্মীলন করো। 'মেল' বলতে অনেক বা বেশিও বোঝায়। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল, মেলা শব্দের মধ্যে তিনটি অর্থ-ই রয়েছে, থাকাটাও জরুরি।

কিন্তু কোন কারণে যদি তিনটার পরিপূরক না হয়ে, একদিকে ঝুঁকে পড়ে তা হলেই 'মেলা' আর 'মেলা-উৎসব' হয়ে উঠে না। অমর একুশে বইমেলা কি তার তিন রূপের একীভূত চরিত্র হারিয়ে কেবলই মেলা-বেশি অর্থের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? আমাদের বইমেলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষা ছিল, সে উৎসবের প্রতিনিধিত্ব করবে, উৎসব অর্থে যে মেলা বোঝায়- তার স্বরূপে প্রকাশিত হবে। কিন্তু ২০২৪-এ এসে দেখা যাচ্ছে যে, বইমেলা সেই চরিত্র হারিয়ে 'বই মেলা'য় পরিণত হয়েছে। এ কারণে আমাদের ভাবার সময় এসেছে বইমেলার মৌল চরিত্র নিয়ে। যে চরিত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত রয়েছে আমাদের একুশের চেতনা, মাতৃভাষার ন্যায়সঙ্গত-ন্যায্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠার হিরণ্ময় অধ্যায়, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালির আবেগ ও আত্মসম্মানবোধের ঐতিহাসিক পরম্পরা আদতে কতটুকু বজায় আছে। 

বইমেলাকে আমরা সত্যিকারার্থে বইমেলা'য় পরিণত করব, নাকি বই মেলার দিকে ঠেলে দেব- সেটা নিয়ে জোরদার আলাপ ও তর্কচর্চা প্রাসঙ্গিক। বইমেলা যে ভাবে চলছে- সেভাবেই চলবে কি? যেভাবে তার মান-মর্যাদা,আভিজাত্য ও কৌলীন্য ক্রমশ তলানির দিকে। আমরা কি সেসব নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে কেবলই দেখব, সংশোধনের জন্য কিছুই করব না? বইমেলার জন্ম হয়েছে একুশের চেতনা থেকে। তার নামেই রয়েছে অমর একুশের গৌরবজনক উপস্থিতি। তাহলে আমরা কেন তার চারিত্র্যর অবনমন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ প্রকাশ করব না? 

প্রতি বছর কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার বই প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমির কাছে পুরো তালিকা না থাকায়, প্রকৃত সংখ্যাটা অজানা। কারও কারও মতে সংখ্যাটা তার থেকেও বেশি-পাঁচ হাজারের কাছাকাছি, তবে তিনহাজারের কম নয়। প্রশ্ন হল আমাদের তিনহাজার লেখক কি আছেন? একটা মেলাকে ঘিরে তিন হাজার বই উৎপাদন করার মতো 'প্রকাশনা ইন্ডাস্ট্রি' কি আমরা দাঁড় করাতে পেরেছি? আমাদের কয়জন লেখক আছেন, যিনি বা যারা পেশাদার। কেবল লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়জন, একজনও নেই। দুই একজন-এর নাম শোনা গেলেও আতশীকাচ দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। যাদের নাম শোনা যায়-উনারা অন্যবিধ সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়েই পেশাদার লেখকের তকমা সাঁটিয়ে রেখেছেন।

ঝাঁকের কৈ-এর মতো লেখকের ভীড়ে প্রকৃত লেখকের সংখ্যা যে কম, বলাবাহুল্য। একারণে ভাল বইয়ের সংখ্যাও কম। বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় তার মধ্যে সব থেকে বেশি প্রকাশিত হয় কবিতার বই। তার পরে রয়েছে গল্প-উপন্যাসের বই-কথা সাহিত্য। মেলা জুড়ে থাকে শিশুতোষ বইয়ের আধিক্য। ইদানীং যুক্ত হয়েছে মোটিভেশনাল স্পিকারদের বই। বাজার বেশ রমরমা।

২০২৪ সালের মেলায় নতুন বই ছাড়া মেলায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টল, ছবি: ইমরান মাহফুজ/ স্টার

গত শতাব্দীর আট ও নয় এর দশকের একটা লম্বা সময় জুড়ে ডেল কার্নেগীর সরব উপস্থিতি ছিল। সেই সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। ইতি টানার কথা ছিল ওই ধরণের পঠন-পাঠনে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ডেল কার্নেগী আবার সদম্ভে ফিরে এসেছে- নিজে এবং মোটিভেশনাল স্পিকারদের হাত ধরে-নানা রূপে। ডেল কার্নেগীর এই ফিরে আসায় কি এটাই প্রতীয়মান হয় বৌদ্ধিকতায় আমাদের যতটা এগোনের কথা ছিল, ততটা হয়নি, উপরন্তু আমরা ভূতগ্রস্ত হয়েছিল এবং পেছনে হেঁটেছি।

বইমেলায় সব থেকে গৌণ অবস্থানে রয়েছে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের বই। যতদিন যাচ্ছে এই অবস্থার অবনমন হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা থেকে এই ধারাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেসব-এতবেশি গোঁজামিলে ভরা যে, তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো সুযোগ কম।

এক্ষণে শরণ নিতে হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তের দপ্তরের। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন : ''সাহিত্যের বাজার দেখিলাম। দেখিলাম, বাল্মীকি প্রভৃতি ঋষিগণ অমৃতফল বেচিতেছেন। বুঝিলাম, ইহা সংস্কৃত সাহিত্য। দেখিলাম, আর কতকগুলে মনুষ্য লিচু পীচ পেয়ারা আনারস আঙ্গুর প্রভৃতি সুস্বাদু ফল বিক্রয় করিতেছেন- বুঝিলাম এ পাশ্চাত্য সাহিত্য। আর একখানি দোকান দেখিলাম- অসংখ্য শিশুগণ এবং অবলাগণ তাহাতে ক্রয় করিতেছে- ভিড়ের জন্য তন্মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলাম না- জিজ্ঞাসা করিলাম, ''এ কিসের দোকান?'' বালকেরা বলিল, বাঙ্গালা সাহিত্য''। বিক্রেয় পদার্থ দেখিবার বাসনা হইল। দেখিলাম- খবরের কাগজে জড়ানো কতকগুলি অপক্ক কদলী।'' (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্তের দপ্তর, বঙ্কিম রচনাবলী)।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কথা বলেছিলেন ঢের আগে। উনার মৃত্যুর পর সোয়া শত বছর পেরিয়ে এসেও অবস্থার যে খুব বেশি হেরফের হয়েছে- এমনটা বলা যাবে না। বইমেলার নামে আমরা কি সত্য-সত্যই 'খবরের কাগজে জড়ানো কতগুলি অপক্ক কদলী'র বিকিকিনি করছি না? এই প্রশ্ন তোলারও কেই নেই, আমাদের এক বইমেলাতেই তিন হাজার বা তার চেয়েও অধিক বইয়ের লেখক-কবি-সাহিত্যিক মিলছে ঠিকই কিন্তু প্রশ্ন করার মতো একজন বুদ্ধিজীবীও মিলছে না।

মেলার চরিত্রের দিক থেকে বইমেলা রয়েছে অনন্য এক জায়গায়। বেশীর ভাগ মেলার একটা ধর্মীয় আবহ থেকে। কোন কোন মেলাতো ধর্মীয় চেতনারই সম্প্রসারণ ও সম্প্রচার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে অমর একুশে বইমেলা ব্যতিক্রম ও অনন্য। পৃথিবীতেই সম্ভবত এরকম নজির দ্বিতীয়টি রয়েছে কি-না আমাদের জানা নেই। আমাদের বইমেলার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সর্বজনবিদিত। এর সঙ্গে যুক্ত আছে এক মাসের সময় পরিসর। সবচেয়ে বড় কথা এই মেলার চেতনায় রয়েছে একুশের আবেদন ও নিবেদনের সকল আবেগ-অনুভূতি, শ্রদ্ধা ও প্রেম।

একুশের চেতনা ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র নির্মাণের। যেখান ন্যায়সঙ্গত অধিকার বাস্তবায়িত হবে, সকল স্তরে-সর্বত্র ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ এবং বৈষম্য কমিয়ে সকলের জন্য সুসম অধিকার বাস্তবায়ন করা হবে। একুশের মূল চেতনা ছিল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বাংলা ভাষার ওপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায়কে প্রতিহত করার। মনে রাখতে হবে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই মানুষের ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্য অধিকারসমূহ গভীরভাবে নিহিত থাকে। একারণে মাতৃভাষার অধিকারের অর্থ হল, ওই জনগোষ্ঠীর-ওই ভূখণ্ডের সকল মানুষের গণতন্ত্রের অধিকার, সুশাসনের অধিকার, ভোটের অধিকার, সামাজিক সুরক্ষার অধিকার বাক্ স্বাধীনতার অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অধিকার। 

এসবের সঙ্গে মৌলিক পাঁচটি অধিকারও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। অবশ্য, মৌলিক অধিকার এখন আরও বেড়েছে। ইদানীং বলা হচ্ছে প্রযুক্তির সুবিধা প্রাপ্তির অধিকারও মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমরা মনে করি, মাতৃভাষার অধিকারের মধ্যেই এসব কিছু গভীরভাবে যুক্ত ও সম্পর্কিত রয়েছে। এ কারণে, আমাদের কেবল বইমেলা করলেই হবে না। বইমেলার সঙ্গে সঙ্গে এসব দিকেও নজর দিতে হবে। এসবে আমাদের কতটুকু অগ্রগতি হল, সেসবেরও খোলতাই হওয়া দরকার। যদি আমরা এগুলো উপেক্ষা বা আড়াল করার চেষ্টা করি, তা হলে বুঝতে হবে আমাদের বইমেলা কেবলই বই মেলায় পরিগণিত হয়েছে। বায়সিকভাবে যে মেলার বয়স অর্ধশতাব্দ পেরিয়েছে। সেই মেলা যদি এসব নিয়ে কথা বলার সেই মাপের কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক এককথায় বুদ্ধিজীবী তৈরি করতে সমর্থ না হয়, তা হলে এর চেয়ে বেদনা ও আক্ষেপের আর কী হতে পারে!

একুশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অগ্রভাগে ছিল বুদ্ধিজীবী সমাজ। বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রথমত শুরু হয় বৌদ্ধিক লড়াই। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষেরা। সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের গড়ে তোলা পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়েই রাজনীতিবিদরা মাতৃভাষার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয় এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা নিশ্চিত করে। প্রশ্ন হল, বৌদ্ধিকতায় সেই পরম্পরা কি প্রবহমান রয়েছে? মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, হাসান হাফিজুর রহমানের মতো বুদ্ধিজীবীদের উত্তরসূরি তৈরি হয়েছে?

উত্তর ইতিবাচক হলে এটা অন্বেষণ করা জরুরি যে, উনারা কোথায়- তেমন কোনো ভূমিকা কি দৃশ্যমান হয়, সময় ও জনদাবি-প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে? এর উত্তর যদি না হয়, তা হলে বুঝতে হবে আমরা একুশের চেতনাকে অনুষ্ঠান সর্বস্বতায় পরিগণিত করেছি। বইমেলাকে বই মেলাতে পরিগণিত করেছি। এ কারণে আমাদের লেখক আছে কিন্তু বুদ্ধিজীবী বা মেধাজীবী নেই।

এক্ষণে জেনে নেয়া যেতে পারে, বুদ্ধিজীবী বা মেধাজীবী এই শব্দবন্ধের প্রকৃত অর্থ কী? এডওয়ার্ড সাইদ মনে করেন, গ্রামশি মেধাজীবীদের দুভাবে দেখেছেন।

এক. পরম্পরাভিত্তিক মেধাজীবী শিক্ষক, পুরোহিত কিংবা প্রশাসক, যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একই রকম কাজ করে চলেছেন।
দুই. জৈব মেধাজীবী- স্বার্থ হাসিলের জন্য, ক্ষমতা আদায়ের জন্য কাজে লাগানো হয় এদেরকে। জৈব মেধাজীবীরা চলমান, গতিময়।

অন্যদিকে, জুলিয়েন বেন্দা সংজ্ঞায়িত মেধাজীবীরা একেবারেই বিপরীত ধর্মী-চরম বিপরীতে এদের অবস্থান। বেন্দার বলছেন, প্রকৃত মেধাজীবীরা অধিবিদ্যার  জোরে নিঃস্বার্থভাবে ন্যায় ও সত্যের নীতিতে অবিচল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন, দুর্বলকে রক্ষা করেন, অন্যায় অত্যাচারী শাসনতন্ত্রকে কাঁচকলা দেখান। যেমনটা দেখা গেছে, ফেনেলন ও ম্যাসিলনের মধ্যে চতুর্দশ লুইয়ের যুদ্ধের নিন্দায়। ভলতেয়ার যেভাবে মুখ খুলেছিলেন প্যালাতিনেতের ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে। রেনঁ যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছিলেন নেপোলিয়ন কর্তৃক বিপুল হিংসাকে। নিতশে যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রতি জার্মান পাশবিকতাকে। বাকল যেভাবে ঘৃণা জানিয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের মনোভাবকে।

যে কোন মেলারই একটা বারোয়ারি দিক থাকে। কিন্তু সেটা যেন মূলধারা না হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। ক্ষেতে আগাছা থাকে, কিন্তু আগাছাই যেন ক্ষেতের পরিচয় না হয়ে ওঠে। বইমেলার ক্ষেত্রে এসব নিয়ে আমরা কি ভাবিত হচ্ছি, নাকি কেবলই চেয়ে চেয়ে দেখছি।

বেন্দার আরও জানাচ্ছেন, আজকের দিনে মেধাজীবীর সমস্যাটা দাঁড়িয়ে আছে এখানেই যে, তারা তাদের নৈতিক কর্তৃত্বেও সবটুকু ঢেকে রেখেছে, ওই দূরদর্শী ভাষায়, 'সমষ্টির আবেগজাত জিগির-এর আড়ালে। এই সংগঠন দলবাজি, গণ-সেন্টিমেন্ট, জাতীয়তাবাদী যুদ্ধজিগির, শ্রেণীস্বার্থের মতো হরেক চেহারায় দেখা দিতে পারে।...সরকারের তরফে দাসসুলভ কিছু মেধাজীবী থাকা কতখানি প্রয়োজনীয়, যারা কখনোই হয়তো নেতৃত্ব দেবে না, কিন্তু সরকারি নীতিকে সংহত করবে, সরকারি শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচার শানাবে, আর বৃহত্তর ক্ষেত্রে জাতীয় গৌরবের নামে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক যৌক্তিকতার আড়ালে দিনকে রাত করে মজবুত করা হবে 'অরওয়েলীয় নিউজপিক'-কে।

'অরওয়েলীয় নিউজপিক'- এর কথা বেন্দা বলেছিলেন ১৯২৭ সালে- যখন গণমাধ্যমের আবির্ভাব আজকের দিনের মতো করে বাড়বাড়ন্ত হয়নি, তারপরও কতোটা নির্মম সত্য এই উচ্চারণ তা আজকের দিনে পৃথিবীর দেশে দেশে আরও বেশি করে উন্মোচিত হচ্ছে। এই অচলায়তন ভাঙতে পারে- আলোয় মোড়া কুৎসিত এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রকৃত সেবকরা-যারা সমাজ রাষ্ট্র দেশে পালন করবেন বেন্দা বর্ণিত মেধাজীবীর ভূমিকা।

সত্যিই যদি, একুশের চেতনা অর্থবহ করার ইচ্ছে থাকে তা হলে বুদ্ধিজীবীর কোন বিকল্প নেই। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা ছাড়া কোন সমাজ-রাষ্ট্র এগোতে পারে না। প্রশ্নের চর্চা জারি থাকলেই ক্ষমতার কার্যকারিতা রক্ষিত হয়, সুসম বিন্যাস ঘটে এবং সকলে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু পায়। প্রশ্নের মধ্যেই ক্ষমতার সৌন্দর্য রক্ষিত থাকে। তা না হলে ক্ষমতা অসী হয়ে ওঠে, শাসক প্রশাসকের ন্যায়দণ্ড হয় না।

আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় স্বীকৃত ও সম্মানিত। এই প্রাপ্তি আমাদের জন্য পরম গৌরবের। এখন আমরা যদি একুশের চেতনার যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটাতে না পারি। বইমেলাকে প্রকৃতার্থে বইমেলায় পরিণত করা সম্ভব না হয়ে ওঠে, তা হলে সেটা হবে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা।

যে কোন মেলারই একটা বারোয়ারি দিক থাকে। কিন্তু সেটা যেন মূলধারা না হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। ক্ষেতে আগাছা থাকে, কিন্তু আগাছাই যেন ক্ষেতের পরিচয় না হয়ে ওঠে। বইমেলার ক্ষেত্রে এসব নিয়ে আমরা কি ভাবিত হচ্ছি, নাকি কেবলই চেয়ে চেয়ে দেখছি।

মনে রাখতে হবে বইমেলার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল একট বইপড়ুয়া জাতি-গোষ্ঠী তৈরি করা। একুশের চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। বই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। এ জন্য প্রয়োজন ভাল বই-মানসম্পন্ন বই। যে বই চোখ খুলে দেয়। যে বই প্রশ্ন করতে শেখায়, প্রশ্নের জন্য আগ্রহী করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বনফুলকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, 'গল্প-উপন্যাস না পড়িলেও চলিবে, কিন্তু প্রবন্ধ পড়িতেই হইবে।' বইমেলার আয়োজক যারা, তাদের কি এসব নিয়ে কোন ভাবান্তর আছে? আক্ষরিক অর্থেই 'বই মেলা' অর্থাৎ সংখ্যাগত দিক দিয়ে মানহীন-শিল্প-সৌষ্ঠবহীন-কুরুরিচকর-অসম্পাদিত বইয়ের মেলা হয়ে উঠলেও তাদের কি-কিছুই বলা বা করার নেই? এই কি আমাদের একুশের চেতনা? একুশে বইমেলা কি একুশের চেতনা ধারণ করছে, নাকি সেই চেষ্টা জারি রেখেছে?

Comments

The Daily Star  | English

'State intelligence agency' is attempting to form political party, Rizvi alleges

Doubts are growing as to whether there are subtle efforts within the government to weaken and break the BNP, he also said

3h ago