একসঙ্গে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়

ছবি: সংগৃহীত

সামিন (ছদ্মনাম) ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন মেঘাকে। চার বছরের প্রেম আর ছয় বছরের সংসারে আছে একটি সন্তানও। কিন্তু হঠাৎ করেই তার ভালো লাগতে শুরু করল তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র চঞ্চল স্বভাবের আমরিনকে। তার কেবলই মনে হতে থাকল, ঠিক এমন একটি মেয়েকেই খুঁজছিলেন জীবনে। তবে তিনি স্ত্রী মেঘাকেও ভালোবাসেন। তার মতে, দুজনকেই তিনি ভালোবাসেন এবং সম্মান করেন। কাউকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ।

তমা (ছদ্মনাম) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কলেজ জীবন থেকেই তার প্রেম রাহাতের সঙ্গে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সহপাঠী সাজিদকেও ভালো লাগতে শুরু করে তার। দুজনের প্রেমের সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, তমা রাহাতের প্রতিও ভালোবাসা অনুভব করছেন, আবার সাজিদকেও তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হচ্ছে।

ভালোবাসার অনুভূতি সুন্দর। আমাদের কোনো মানুষকে যখন দেখে ভালো লাগে, তার প্রতি এক বিশেষ ধরনের ভালো লাগার সৃষ্টি হয়, তখন হৃদয়ঘটিত সেই বিষয়টির আমরা নাম দিই প্রেম। অনেকেই বলেন প্রেম স্বর্গীয়। তবে প্রেমের সম্পর্ক যতটা মধুর, ঠিক ততটাই জটিল। সাধারণত মন দেওয়া-নেওয়ার এই সম্পর্কটি একজনের সঙ্গে হয়ে থাকে। তবে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে থাকাকালীন আরেকজনের প্রতিও ভালোবাসা অনুভব করা মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।

এই যে একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে থাকাকালীন আরেকজনকে ভালোবাসা বা তার প্রতিও প্রেম অনুভূত হওয়ার বিষয়টি, এটি কি স্বাভাবিক? অদ্ভুত এ অনুভূতির নাম কী? কেন হয় এমনটা? 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয় এসব প্রশ্নের উত্তর।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক  থাকাকালীন অন্যের প্রতি ভালোবাসা অনুভূত হওয়া বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'পলিঅ্যামোরি'। এক্ষেত্রে ব্যক্তির একাধিক জনের প্রতি সমান অনুভূতি কাজ করবে। তিনি মনে করতে থাকবেন, তিনি এই একাধিক জনকেই ভালোবাসেন, সম্মান করেন এবং কাউকেই ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পলিঅ্যামোরির ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্ক মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না, হৃদয়ঘটিত অনুভূতিটাই মুখ্য। ব্যক্তি যখন তার সঙ্গীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভালোবাসা না পান, তখন তিনি অন্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং সেটিও একসময় প্রেমের সম্পর্কে  মোড় নেয়।

নারী-পুরুষ দুজনের ক্ষেত্রেই পলিঅ্যামোরি দেখা যেতে পারে। পলিঅ্যামোরিকে অনেকেই পরকীয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। পরকীয়ার সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হলো, পরকীয়ায় হয়তো একজনকেই ভালোবাসা হয় আর পলিঅ্যামোরিতে দুজনকেই ব্যক্তি ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন। এই সমস্যার ক্ষেত্রে নেই কোনো লিঙ্গ, নেই কোনো বয়স।

কিছু মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, মূলত একাকীত্ব, সঙ্গীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব থেকে পলিঅ্যামোরি দেখা দেয়। এই মানসিক একাকীত্ব মধ্যবয়সে দেখা দিতে পারে। তাই মধ্যবয়সে পলিঅ্যামোরির সম্মুখীন হওয়ার হার বেশি। বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত সবার মধ্যেই এটি দেখা দিতে পারে।

এই বিষয়টি স্বাভাবিক কি না প্রশ্ন করা হলে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'প্রথমত এটি আমাদের এখানে সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে আপনার সঙ্গীদেরকে ঠকানো হয়, যা নৈতিকভাবেও ঠিক নয়। তবে কখন কার প্রতি ভালোবাসা অনুভূত হয় সেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। সবার মানসিক জোর একরকম না থাকার কারণে একটি সম্পর্কে থেকে অপর একটি সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে লুকিয়ে সম্পর্কগুলো জিইয়ে রাখতে হয়।

এই অনুভূতি আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেঙে যায় সম্পর্ক। যদি এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যান তবে নিজেকে প্রশ্ন করুন যদি আপনার সঙ্গীরা জানতে পারেন তবে কী ফলাফল হবে, সামাজিকভাবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি থাকবে।'

'অনেকে নিজের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। হয়তো বলতে পারেন ভালোবাসার ওপর তো আর হাত নেই কারো। একটি সম্পর্কে থেকে অন্য কাউকে পছন্দ করা শুরু করতেই পারেন। তবে এটি স্বাভাবিক হিসেবে না নেওয়াই শ্রেয়। একই সময়ে একাধিক জনকে মনে জায়গা দেওয়ার বিষয়ে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে', পরামর্শ দেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, 'অনেকে পলিঅ্যামোরিতে ভুগছেন তা বুঝতেই পারেন না। তবে যতদিনে বুঝতে পারেন ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়। মনোজগতের পরিবর্তনে কখন, কোন কারণে, কার প্রতি কী অনুভূতি আসে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে এর ফলাফল জীবনকে করে তোলে বিপর্যস্ত।'

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, এটি সমাধানযোগ্য মানসিক সমস্যা। পলিঅ্যামোরির লক্ষণ নিজের মধ্যে দেখলে একজন মনোরোগ কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হতে পারেন। অন্যান্য মানসিক রোগের মতো এ সমস্যার কোনো ওষুধ নেই। তবে সঠিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব অনেকখানি। যদি আপনার সঙ্গী বা পরিচিত কারো মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয় তবে তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন।

 

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago