নির্বাচনের ২ দিন পর পোস্টাল ব্যালট হাতে পান সুইজারল্যান্ড প্রবাসী

নির্বাচনের ২ দিন পর পোস্টাল ব্যালট হাতে পেলেন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী খান মোহাম্মাদ বাকি উল্লাহ বরিশাল-৩ সংসদীয় আসনের ভোটার। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার জন্য নিয়ম মেনে তফসিল ঘোষণার পরপরই বরিশালের রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন তিনি।

বাকি উল্লাহ বলছেন, আবেদন করার পর তিনি ডাকযোগে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ব্যালটপেপার ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র পেয়েছেন ভোটের দুদিন পর, অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি। খামের ওপর লেখা তারিখ দেখে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সেটা পাঠানো হয়েছে ৩ জানুয়ারি।

এমন পরিস্থিতিতে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাকি উল্লাহ এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি।

শারীরিকভাবে সরাসরি ভোটদানে অসমর্থ ভোটাররা আগে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে কিছু প্রক্রিয়া মেনে তা ডাকযোগে প্রেরণ করে ভোট দেওয়ার পদ্ধতিকে বলা হয় পোস্টাল ব্যালট ভোট।

ঢাকার নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এবারে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১০ হাজারের মতো আবেদন জমা পড়েছিল। ভোট দিয়েছেন মোট ১ হাজার ৯৪০ জন। তবে এর মধ্যে কতজন প্রবাসী ভোটার ও কতজন দেশে থেকেই ভোট দিয়েছেন সে তথ্য আলাদাভাবে পাওয়া যায়নি।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ডাকযোগে ভোট দেওয়ার এই সুযোগ তৈরি করা হয়। একই প্রক্রিয়ায় ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন থেকে প্রবাসীরা এই সুযোগ পেয়ে আসলেও এবারের মতোই সেভাবে সাড়া মেলেনি।

এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, আইনগতভাবে পোস্টাল ব্যালটের ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকলেও নানা ধরনের জটিলতায় এ নিয়ে আগ্রহ থাকে না ভোটারের। বিষয়টি নিয়ে প্রচার-প্রচারণার অভাব যেমন আছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের এ সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট কম পড়ার একটি কারণ। পাশাপাশি কমিশনের প্রতি ভোটারের বিশ্বাস ও আস্থার অভাবও এর জন্য দায়ী।

নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ভোটার, প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার, চাকরিসূত্রে নিজ এলাকার বাইরে বসবাসকারী সরকারি চাকরিজীবী এবং কারাবন্দিরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে আবেদন করতে পারেন।

আবেদন পাওয়ার পর ওই ভোটারের কাছে ডাকযোগে একটি পোস্টাল ব্যালট পেপার ও একটি খাম পাঠান রিটার্নিং কর্মকর্তা। এরপর আবেদনকারী ভোট দিয়ে ব্যালট পেপার পাঠালে তা মূল ফলাফলের সঙ্গে যোগ করা হয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার তালিকায় প্রায় ১২ কোটি ভোটার ছিল। এর মধ্যে লাখো প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারের পাশাপাশি ভোটের দিন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যসহ কারাবন্দি মিলিয়ে কয়েক লাখ ভোটারের পোস্টাল ব্যালট ব্যবহারের সুযোগ ছিল।

দুই নির্বাচনে আবেদন করেও ভোট দিতে পারলেন না বাকি উল্লাহ

পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে চাইলে তফসিল ঘোষণার পর ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয় নিজের নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। সে অনুযায়ী এবার আবেদন করার সুযোগ ছিল ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।

বাকি উল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৮ সালের নির্বাচনেও ভোট দেওয়ার আবেদন করেছিলাম। সেবার ব্যালট পাইনি। এবার পেলাম। কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন পর।'

পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার 'দুয়েকদিনের মধ্যেই' প্রথমে ইমেইলের মাধ্যমে বরিশালের রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন বলে জানান বাকি উল্লাহ।

বলেন, 'সময় নষ্ট করিনি। সার্কুলার হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথমে ইমেইলে আবেদন করলাম। পরে অধিকতর সতর্কতার অংশ হিসেবে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে লিখিত আবেদন পাঠালাম। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো চিঠি পেলাম ৯ জানুয়ারি। খামের ওপর দেখলাম সেটা পাঠানো হয়েছে ৩ তারিখে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটের আগে তিনদিনের মধ্যে একটা চিঠি কি সুইজারল্যান্ডে পৌঁছানো সম্ভব? পৌঁছালেও সেটা কি ফেরত আসা সম্ভব?'

এ সময় খানিকটা শ্লেষের স্বরেই তিনি বলেন, '২০১৮ সালের নির্বাচনেও আমি অনেক প্রবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম আবেদন করার জন্য। আগেরবার ব্যালটই পাইনি। এবার তো পেলাম। তাতে মনে হচ্ছে এবার বোধহয় আরেকটু এগিয়ে গেলাম।'

গত ৩২ বছর ধরে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে বসবাসরত এই প্রবাসী আরও বলেন, 'আমরা জানি এ বছর রাষ্ট্রপতি পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়েছেন। আমাদের উৎসাহিত করেছেন। তাহলে এমন হলো কেন? একটু গুছিয়ে কি এটা করা সম্ভব ছিল না? প্রবাসীদের ভোটের জন্য আলাদা একটা সেল হতে পারত। আমাকে যে ব্যালট ডাকযোগে পাঠানো হলো, সেটা তো ইমেইলেও পাঠানো সম্ভব ছিল।'

এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ভোট নিতে আদৌ নির্বাচন কমিশন আগ্রহী কি না—এমন প্রশ্ন তুলে বাকি উল্লাহ বলেন, 'প্রতিটা ইএমএসের (এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস) খরচ ৩ হাজার ২০০ টাকা। সবমিলিয়ে দুইটা চিঠির জন্য খরচ ৬ হাজার ৪০০ টাকা। এটা তো জনগণের টাকা। আমি তো ভোট দিতে পারলাম না। এই টাকার হিসাব কে দেবে?'

খান মোহাম্মাদ বাকি উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

৪৬৪টি ব্যালটের একটিও পৌঁছায়নি বরিশাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে

পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য এবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় বরিশাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মোট ৪৬৮টি ব্যালট পেপার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এর একটিও এখন পর্যন্ত ফেরত আসেনি বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বরিশালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শহিদুল ইসলাম।

বিলম্বে ব্যালট পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা পর্যায়ক্রমে ২ ও ৩ জানুয়ারি ব্যালটগুলো পাঠিয়েছি। হাতে পেয়েছি ১ জানুয়ারি। এ ছাড়া, বরিশালের দুটি আসনের প্রার্থীতা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা ছিল। সে কারণেও ব্যালট পেতে দেরি হয়েছে।'

৩ তারিখে ব্যালট পাঠালে প্রবাসীদের পক্ষে কীভাবে ৭ তারিখের ভোটে অংশ নেওয়া সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের দায়িত্ব ব্যালট পাঠানো পর্যন্তই। এর বেশি আমরা কী করতে পারি?'

সুইজারল্যান্ডে পোস্টাল ব্যালট পেপার দেরিতে পৌঁছানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ সম্পর্কে আমি অবগত নই।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেকে ব্যালট হাতে পেলেও সাড়া দেননি। কেউ কেউ এক জেলার ভোটার হলেও অন্য জেলা থেকে ভোট দিতে পোস্টাল ব্যালটের জন্য আবেদন করেছেন।'

পোস্টাল ব্যালট ভোট কেন জরুরি

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে আসা সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে। তার ভাষ্য, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়া হার এত কম হওয়ার কারণ হলো নির্বাচন কমিশনের প্রতি ভোটারদের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি।

সুজন সম্পাদক বলেন, ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের একটি ধারায় জেনুইন ইলেকশনের কথা বলা আছে। এই জেনুইন ইলেকশনের একটা পূর্বশর্ত হলো—সব প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটার হওয়া ও ভোটদানের সুযোগ তৈরি করা; তারা দেশে থাকুন কিংবা দেশের বাইরে থাকুন। নির্বাচনের দিনে যারা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন তাদের জন্যও এটা করতে হবে।

তিনি বলেন, 'তারা যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারেন তাহলে সেটা জেনুইন ইলেকশন হয় না। অতীতে আমাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, ঘাটতি ছিল। কিন্তু এখন বিষয়টিতে জরুরি ভিত্তিতে মনোনিবেশ করা দরকার নির্বাচন কমিশনের।'

বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, 'অন্তত দেড় কোটি মানুষ দেশের বাইরে থাকেন। তারা যদি নির্বাচনে ভোট দেন তাহলে ভোটের ফলাফল বদলে যেতে পারে। এটা সিগনিফিকেন্ট। শুধু ভোট দেওয়ার সুযোগই নয়; এই পোস্টাল ব্যালটগুলো যাতে সততার সঙ্গে গণনা করা হয় এটাও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এগুলো নিয়ে নয়ছয় করার সুযোগ থেকে যায়। ওই বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাও তৈরি করতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতিই এখানে সবচেয়ে বড় ঘাটতি।'

পর পর দুই নির্বাচনে আবেদন করেও ভোট দিতে না পারা প্রবাসী বাকি উল্লাহ যেমন বললেন, 'এখন তো আমার মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন নিজেই চায় না যে আমরা ভোট দেই। একই ঘটনা বার বার ঘটতে থাকলে সেটাকে তো দুর্ঘটনা বলা যায় না। তাহলে আমরা তাদের ওপর আস্থাটা আনব কীভাবে?'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago