নগদবিহীন লেনদেনে আসছে আরও ডিজিটাল ব্যাংক
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় শতভাগ শাখাহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে যেতে আরও ডিজিটাল ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন ধারার ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোয় তথা সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও তা বাংলাদেশে নতুন ধারণা।
তবে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী, এমএফএস, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা এবং ডিজিটাল-ফার্স্ট গ্রাহকদের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে যাওয়ায় আরও ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিমালা জারি করে ব্যাপক সাড়া পায়।
ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এমএফএস সেবাদানকারী, মোবাইল ফোন অপারেটর, আইটি ফার্ম, স্টার্টআপ, ফার্মাসিউটিক্যালস ও সিমেন্ট প্রস্তুতকারকসহ প্রায় ৫০০ প্রতিষ্ঠান ৫২টি আবেদন করেছে।
এর মধ্যে নগদ ডিজিটাল ব্যাংক ও কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক গত অক্টোবরে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পেয়েছে।
এ ছাড়াও, তিন ব্যাংক মিলে করা আবেদনটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংক এশিয়ার নেতৃত্বাধীন ডিজিটাল, ব্র্যাক ব্যাংকের নেতৃত্বাধীন বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক ও ১০ বেসরকারি ব্যাংকের সমন্বয়ে ডিজি১০ ডিজিটাল ব্যাংকও চালু হয়ে যেতে পারে।
স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংক, জাপান বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক ও নর্থ ইস্ট ডিজিটাল ব্যাংককে এলওআই দেওয়ার পরিকল্পনা আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
কড়ি ডিজিটাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ এন করিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আরও বেশি মানুষকে আর্থিক ব্যবস্থার আওতায় আনতে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, 'ফিনটেক আর্থিক পরিষেবা গ্রহণকে দ্রুত করতে পারে। ডিজিটাল ব্যাংক এর আরেক ধাপ এগিয়ে।'
ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান 'নগদ' জানায়—আশা করা হচ্ছে, সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে নগদবিহীন লেনদেন ও ডিজিটাল রূপান্তরকে দ্রুত করতে ডিজিটাল ব্যাংকগুলো কাজ করবে।
'নগদ'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেখানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর শাখা নেই আমরা সেখানে পৌঁছে যাব।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬১টি ব্যাংকের শাখা ছিল ১১ হাজার ২০০টির বেশি। এদের অর্ধেকের বেশি ছিল শহরাঞ্চলে।
অর্থনীতিতে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন প্রায় ৫২ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এই পরিস্থিতি ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা লাখ লাখ মানুষের কাছে নগদের মতো ডিজিটাল ব্যাংকগুলোকে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেবে।'
ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে দেশ বৈশ্বিক ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হতে প্রস্তুত।
সারা বিশ্বে ডিজিটাল ব্যাংকের প্রসার দ্রুত বাড়ছে।
মোবাইল ব্যাংক এন২৬ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাকসেনচারের ২০২১ সালের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে—সুবিধার কারণে লাখ লাখ গ্রাহক ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। করোনা মহামারির পর এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
প্রতি চার গ্রাহকের একজন পুরোমাত্রায় ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবহার করছেন। জরিপ করা ২৮ দেশে ডিজিটাল ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। তাদের সংখ্যা আনুমানিক ৪৫ কোটি।
বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল ব্যাংকগুলো সঞ্চয়, ক্রেডিট কার্ড, ব্যক্তিগত ঋণ ও বিনিয়োগসহ নানান আর্থিক পরিষেবা দিয়ে থাকে। গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও সহজ ও সুবিধাজনক ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছেন।
বৈশ্বিক ডেটা ও বিজনেস ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিসটা ডট কমের মতে, চলতি বছরে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর বিশ্বব্যাপী নূন্যতম সুদ আয় ৮২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
চলতি ২০২৪ থেকে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে এই আয়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর ফলে ২০২৮ সালের মধ্যে এর পরিমাণ দাঁড়াবে এক দশমিক ২২ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় কম খরচের কারণে আকর্ষণীয় মুনাফা করছে। ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর শাখা না থাকায় ও তাদের পরিচালন খরচ কম হওয়ায় পরিষেবার জন্য বাড়তি অর্থ গুণতে হয় না।
আরেকটি সুবিধা হলো—ডিজিটাল ব্যাংকগুলো থেকে ২৪ ঘণ্টাই সেবা পাওয়া যায়। প্রযুক্তিপ্রেমী নতুন প্রজন্মের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা দ্রুত আর্থিক সেবা দিতে পারে।
ফিনটেক এমএক্স'র হিসাবে, প্রবীণদের তুলনায় তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের প্রচলিত ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকার সম্ভাবনা অনেক কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন—বাংলাদেশে গ্রাহকরা, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ছেলে-মেয়েরা সশরীরে ব্যাংকে যাওয়া এড়িয়ে চলতে চান। মহামারির কারণে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট'র অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল ব্যাংক আর্থিক খাতকে ডিজিটালকরণের অংশ। এক দশকেরও বেশি সময় আগে দেশে এমএফএস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।'
তার মতে, 'এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিতে ও আমানত গ্রহণ করতে না পারায় এখন ডিজিটাল ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।'
বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল ব্যাংকগুলো সুবিধা পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নেওয়া ২০ থেকে ২৬ শতাংশ সুদের হারের তুলনায় কম সুদে ঋণ পেতে পারবেন।'
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পথিকৃৎ আরফান আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, নতুন প্রজন্ম এর মাধ্যমে সেবা নিতে আগ্রহী।'
তিনি আরও বলেন, 'তবে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর লাভজনক হতে সময় লাগবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজন।'
ডিজিটাল ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ
এন২৬-অ্যাকসেনচার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংকিং আগামী বছরগুলোয় আরও গতিশীল হবে।
এতে বলা হয়েছে, 'আস্থা অর্জন ও ডিজিটাল পরিষেবাগুলোর সঙ্গে অপরিচিতি কাটিয়ে উঠাসহ বেশকিছু বাধা রয়ে গেছে। তবে ব্যবস্থাটি সহজ ও সুবিধাজনক হওয়ায় এর ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।'
বিশ্লেষক ফাহিম মাশরুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোনের ব্যবহার এখনো তুলনামূলক কম।'
বিআইবিএম'র হাবিব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল ব্যাংক সফল হওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর উন্নয়ন ও ডিজিটাল জ্ঞান বাড়ানো।'
'ডিজিটাল জ্ঞান খুব কম হওয়ায় এটি আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অনেকের মোবাইল ফোন থাকলেও তাদের বেশিরভাগেরই ডিজিটাল জ্ঞান ততটা নেই।'
গত জুনে এক সভায় বেসিস জানায়—দেশে ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিগত পরিচয় প্রমাণীকরণ, রিয়েল-টাইম ইন্টারঅপারেবল পেমেন্ট ও সব ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে সমন্বিত ক্রেডিট ব্যুরোর মতো প্রস্তুতি নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি দেশে অনেকটা অপরিচিত। ডিজিটাল ব্যাংকগুলো কী কী সেবা নিয়ে আসছে যা প্রচলিত ব্যাংকগুলো দেয় না এখন তাই দেখার বিষয়।'
Comments