দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে কেন, প্রতিরোধে কী করবেন

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
ছবি: সংগৃহীত

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার সমস্যা অনেকেরই থাকে। দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে বা কুলি করার সময় মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে। এই সমস্যাকে ছোটখাট ভেবে সবাই গুরুত্ব দেন না। এটিকে অবহেলা করলে বা চিকিৎসা না করলে যে বিপদ হতে পারে হতে পারে সে সম্পর্কে অনেকেই জানেন না।

ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের অধ্যাপক ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারির উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা  ডা. অরূপরতন চৌধুরীর কাছ থেকে চলুন সমস্যাটির কারণ, প্রতিরোধ, চিকিৎসাসহ বিস্তারিত জেনে নিই।

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার কারণ

ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় ও পদ্ধতিগত এই দুই কারণে দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে।

১. স্থানীয় কারণ: মাড়িতে ডেন্টাল প্লাক জমা থাকার কারণে মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, ফলে মাড়ি ফুলে যায়। দাঁতের সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এই সময়ে দাঁত ব্রাশ করলে বা শক্ত কোনো খাবার খেলে অথবা সামান্য আঘাতেই মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়। এই অবস্থাকে বলা হয় পেরিওডেন্টাল ডিজিজ। যার দুটি স্তর রয়েছে, প্রথম স্তরটি হচ্ছে জিনজিভাইটিস এবং দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে পেরিওডনটাইটিজ।

২. পদ্ধতিগত কারণ: কারো যদি ব্লাড ক্যান্সার থাকে (লিউকোমিয়া), লিভার সমস্যা থাকে, যদি রক্তের প্লেইটলেট বা হিমোগ্লোবিন কম থাকে যেমন ব্লাড ডিজঅর্ডার বা রক্তের ব্যাধি তাদের মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে। সেইসঙ্গে যারা হৃদরোগের কারণে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খান, রক্ত পাতলা রাখার জন্য ওষুধ খান, অ্যাসপিরিন অথবা ডিসপিরিন বা ক্লোপিড জাতীয় ওষুধ খান তাদের এটি হতে পারে। এ ছাড়া গর্ভকালীন মায়েদের এক ধরনের হরমোনের কারণে মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হয়।

ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণকে খুব সহজভাবে দেখলে চলবে না। এর জন্য রোগীর ইতিহাস, বিভিন্ন রোগের উপস্থিতি ও ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে দেখাতে হবে। প্রয়োজনে রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া যারা ধূমপান করেন, যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাও ঝুঁকিপূর্ণ। ধুমপানের কারণে মাড়িতে প্রদাহ এবং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মাড়িতে তীব্র প্রদাহ হয়। ফলে মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হয়।

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার লক্ষণ

১. মাড়ি লাল হয়ে যাওয়া ও ফুলে যাওয়া।

২. মাড়ি থেকে দাঁতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

৩. দাঁত ব্রাশ করলে বা শক্ত কোনো খাবার চিবিয়ে খেলে রক্ত বের হওয়া।

৪. অনেক ক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠলে মুখে রক্ত দেখা যাওয়া, আবার অনেক ক্ষেত্রে লালার সঙ্গে রক্ত মিশে গিয়ে বিছানায় বালিশেও রক্ত দেখা যাওয়া।

অবহেলা করে চিকিৎসা না নিলে কী হতে পারে

ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, নিয়মিত মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার পরেও যদি চিকিৎসা না হয় তবে মাড়ির প্রদাহের কারণে দাঁতের সাথে মাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, ধীরে ধীরে দাঁত নড়ে যাওয়া এবং যে কোনো সময় পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া মাড়ির এই প্রদাহের কারণে বিভিন্ন জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া রক্তে মিশে দেহের অন্যতম প্রধান অঙ্গসমূহ যেমন হার্ট বা হৃদযন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে, হৃদরোগ হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মাড়ি থেকে ব্যাকটেরিয়া ভবিষ্যৎ শিশুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, শিশু কম ওজনের হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থেকে ব্লাড সুগার বা শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধের চিকিৎসা

ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধের চিকিৎসা দুই ধরনের। যদি স্থানীয় কারণে হয়ে থাকে তবে ডেন্টাল প্লাক (দাঁতের ওপর লেগে থাকা খাদ্য কণার শক্ত আবরণ) পরিষ্কার করা। এর জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায় হচ্ছে ডেন্টাল স্কেলিং। অধুনিক আলট্রাসনিক স্কেলার যন্ত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই দাঁতের সঙ্গে লেগে থাকা ডেন্টাল প্লাক বা শক্ত আবরণ পরিষ্কারভাবে সরিয়ে দেওয়া যায়।

যদি মাড়ি প্রদাহের কারণে ফুলে যায় তবে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরে মাড়ির শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে, যাকে বলা হয় জিনজিভেকটমি বা রুট প্ল্যানিং। এর ফলে মাড়ি পরবর্তীতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে আর রক্তক্ষরণ হওয়ার সুযোগ থাকে না।

দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া প্রতিরোধ

১. মাড়ির রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে প্রতিদিন দুইবেলা সকালে নাস্তার পরে ও রাতে খাওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করা।

২. ওপরের পাটি থেকে নিচের পাটি এবং নিচের পাটি থেকে ওপরের পাটি এইভাবে ওপর নিচ বা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। যাতে প্রত্যেকটি দাঁতের বাইরের এবং ভেতরের পাটির প্লাক থেকে খাদ্য কণা পরিষ্কার হয়।

৩. নিয়মিত দাঁত ব্রাশেরেআগে ডেন্টাল ফ্লশ (একজাতীয় সিল্কের পিচ্ছিল সূতা) দিয়ে দুই দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্যকণা পরিষ্কার করা এবং একজাতীয় মাউথ ওয়াশ আয়োডিন দিয়ে কুলিকুচি করা।

৪. প্রতিদিন ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল যেমন- কমলালেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, আমলকি, আমড়া, কলা এবং মাল্টা খেতে হবে। তাছাড়াও প্রতিদিন সালাদ হিসেবে গাজর, টমেটো, শশা, লেবুর রস ইত্যাদি খাওয়া।

৪. ধূমপান বা তামাকজাতীয় খাদ্য বর্জন করা।

৫. ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা (নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ওষুধ সেবন)।

দাঁত মাজতে কী ধরনের ব্রাশ ব্যবহার করবেন

ডা. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, প্রত্যেকেরই দাঁতের ও মাড়ির প্রকৃতি অনুযায়ী টুথব্রাশ ব্যবহার করা প্রয়োজন। যেমন নরম, মধ্যম ও শক্ত টুথব্রাশ। আর তা নির্ধারণ করে দেবেন ডেন্টিস্ট।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নরম বা মধ্যম ধরনের টুথ ব্রাশ ব্যবহার করতে দেখা যায়। টুথব্রাশের সময়সীমা বা কতদিন ব্যবহার করা যায় সেটিও খেয়াল রাখার কথা বলেন এই চিকিৎসক। টুথব্রাশের ফাইবার বা ব্রিসলগুলো যখন সোজা না থেকে বাঁকা হয়ে যায় তখনই ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে যায়।

আর সবার জন্য গ্রহণযোগ্য পেস্ট হচ্ছে ফ্লুরইড যুক্ত টুথপেস্ট অর্থাৎ যে টুথপেস্টে ফ্লুরাইড আছে সেটাই স্বাস্থ্যসম্মত। কারণ ফ্লুরাইড দাঁতের ক্ষয় বা ডেন্টাল ক্যারিজ রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। অনেকেই টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে এক ধরনের সেনসিটিভ টুথপেস্ট ব্যবহার করেন। কিন্তু সেনসিটিভ দাঁতের জন্য বিজ্ঞাপনে দেখানো টুথপেস্ট ব্যবহার করা উচিত নয় বলে জানান ড. অরূপরতন চৌধুরী।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago