ঘুম থেকে উঠেই ঘাড়ে ব্যথার কারণ জানেন কি

কারণ ও প্রতিরোধের উপায় জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোস্কপি অ্যান্ড জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি ইউনিট, অর্থোপেডিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আলী ফয়সালের কাছ থেকে।
ঘুম থেকে উঠেই ঘাড় ব্যথা
ছবি: সংগৃহীত

ঘুম থেকে উঠার পর ঘাড়ে, কাঁধে ব্যথা অনুভব করছেন কিংবা দিনের অন্য সময়েও ব্যথা হচ্ছে?

এর কারণ ও প্রতিরোধের উপায় জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোস্কপি অ্যান্ড জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি ইউনিট, অর্থোপেডিক বিভাগেরসহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আলী ফয়সালের কাছ থেকে।

ঘুম থেকে উঠার পর এবং বিভিন্ন সময় ঘাড়ে ব্যথা হয় কেন

ডা. ফয়সাল বলেন, ঘাড়ে এবং কাঁধে ব্যথা হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন-

১. রাতে ঘুমানোর সময় যে বালিশ ব্যবহার করি সেটি যদি ঠিকমত ব্যবহার না করি। যেমন- অনেকে উঁচু বালিশ ব্যবহার করেন, কেউ নিচু বালিশ ব্যবহার করেন আবার কেউ একের অধিক অতিরিক্ত বালিশ ব্যবহার করেন। তাদের ক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠার পর অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।

২. ভুল ভঙ্গিতে শোয়ার কারণেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।

৩. একটানা একইভাবে বসে টেলিভিশন দেখার কারণে হতে পারে।

৪. যারা দীর্ঘসময় ধরে ঘাড় নুইয়ে কম্পিউটার বা ল্যাপটপে কাজ করেন তাদেরও ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৫. শিক্ষার্থী যারা একটানা ঘাড় নুইয়ে লেখাপড়া করেন তাদেরও এই সমস্যা হতে পারে।

৬. শুয়ে-বসে কিংবা অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় নুইয়ে মোবাইল দেখা, গেমস খেলা বা বিভিন্ন কাজ করে থাকেন অনেকে। তাদেরও অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকে।

৭. যারা গৃহস্থালির কাজ করেন, যেমন কাপড় ধোয়া, তরকারি কাটা বা ঘাড় নুইয়ে বিভিন্ন কাজ করেন তাদেরও এই সমস্যা হতে পারে।

৮. ঘাড়ে কোনো সময় আঘাত পেলে সেখান থেকেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।

৯. কেউ যদি দুঃশ্চিন্তা, হতাশায় ভোগেন অর্থাৎ কোনো কারণে যদি অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভোগেন তাহলেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।

১০. মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম করার কারণেও অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হয়।

১১. হঠাৎ করে ভারি জিনিস ঘাড়ে নেওয়া অথবা হাতে অতিরিক্ত ওজন বহন করার কারণে পরে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।

১২. এ ছাড়াও ঘাড়ে অনেক হাড় থাকে, হাড়ে যদি কোন ক্ষয় হয়। অথবা ঘাড়ে ডিস্কে প্রলাপস হয় অথবা ঘাড়ের হাড়ে যদি ইনফেকশন হয় তখন অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকে।

ডা. ফয়সাল বলেন, শোয়ার ভঙ্গি ও বালিশের ব্যবহার ঠিক না থাকলে এবং একটানা ঘাড় নুইয়ে কাজ করলে ঘুম থেকে উঠার পর ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা অনুভূত হয়। তবে বাকি কারণগুলোর কারণে শুধু ঘুম থেকে উঠার পর নয় অন্যসময়েও ঘাড়ের ব্যথায় ভোগেন অনেকে।

ঝুঁকিতে কারা

ডা. ফয়সাল বলেন, সাধারণত পুরুষ বা নারী ৪০ থেকে ৬০ বছর যাদের সবার ক্ষেত্রেই ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা হতে পারে । তবে নারীদের বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যারা কোনো নিয়ম মানতে চান না, ঠিকমত বালিশ ব্যবহার করে না, শোয়ার ভঙ্গি ঠিক থাকে না, দীর্ঘসময় মোবাইল, ল্যাপটপ ব্যবহার করতে থাকে বা যারা মানসিক অশান্তিতে থাকেন তাদের ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

এ ছাড়া কারো যদি বাবা, মায়ের ঘাড়ে ব্যথা থেকে থাকে অর্থাৎ জেনেটিক কারণেও ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে বলে জানান ডা. ফয়সাল।

ঘাড়ে সমস্যার লক্ষণ

১. ঘাড়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে ব্যথা হবে। কারো ক্ষেত্রে অল্প ব্যথা হতে পারে বা তীব্র ব্যথাও হতে পারে।

২. যদি তীব্র ব্যথা হয় তখন ঘাড় ডান দিকে, বাম দিকে কিংবা সামনে-পেছনে ঘুরাতে চেষ্টা করলে তখন দেখা যাবে তার কাঁধে প্রচন্ড ব্যথা হতে পারে।

৩. ঘাড়ের মাংসপেশি অনেকসময় শক্ত হয়ে যায়।

৪. অনেক সময় দেখা যায় ঘাড়ের ব্যথা ঘাড় থেকে কাঁধে, কাঁধ থেকে হাতে ও হাতের আঙুলেও চলে আসে। হাত দুর্বল লাগে, ঝিমঝিম করতে থাকে।

ডা. ফয়সাল বলেন, এসব লক্ষণ যদি কারো থাকে তাহলে বুঝতে হবে তার ঘাড়ে কোনো সমস্যা হয়েছে।

ঘাড় ব্যথার সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পর্ক

ডা. ফয়সাল বলেন, ঘাড়ে ব্যথার সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। শীতকালে এই ব্যথা বেশি অনুভূত হয়। কারণ ঠান্ডার কারণে এই সময় ঘাড়ের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায় এবং রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। তাই ঘাড়ে ব্যথা বেশি হয়।

ঘাড়ে ব্যথা হলে হালকা গরম সেঁক দেওয়া যাবে। গরম সেঁক দিলে শক্ত মাংসপেশি শিথিল হয় এবং রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হলে আস্তে আস্তে ব্যথা অনেকাংশে কমে যায়। তবে ঘাড়ে ব্যথায় কখনই মালিশ করা যাবে না, এতে ব্যথা আরও বাড়বে বলে জানান ডা. ফয়সাল।

ঘাড় ব্যথা প্রতিরোধের উপায়

১. ঘুমানোর সময় উঁচু বালিশ ব্যবহার না করে পাতলা বালিশ ব্যবহার করতে হবে। ৪ থেকে ২০ ইঞ্চি পুরু বালিশ ব্যবহার করা।

২. খুব বেশি শক্ত বা খুব বেশি নরম না এরকম বালিশ ব্যবহার করতে হবে ঘুমানোর সময়।

৩. বালিশ এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে মাথা এবং ঘাড় সাপোর্ট পায়।

৪. বিছানা একদম শক্ত হবে না আবার একদম নরম হবে না। মাঝারি ধরনের বিছানা ব্যবহার করতে হবে।

৫. শোয়ার সময় মেরুদণ্ড যাতে বাঁকা না হয়, সোজা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৬. যাদের দীর্ঘসময় একটানা কম্পিউটার বা ল্যাপটপে কাজ করতে হয়, তাদের মনিটর আই লেভেল বরাবর হতে হবে অথবা আই লেভেল থেকে একটু নিচু হতে হবে।

৭. এক নাগাড়ে এক ঘণ্টার বেশি কম্পিউটার বা ল্যাপটপে কাজ করা যাবে না। ১০-১৫ মিনিট বিরতি নিতে হবে।

৮. দীর্ঘসময় একনাগাড়ে ঘাড় নুইয়ে পড়াশোনা করা যাবে না।

৯. গৃহস্থালীর কাজকর্মেও নারীদের নুইয়ে কাজ করা এড়িয়ে ঘাড় সোজা রেখে কাজ করতে পারলে ভালো হবে।

১০. মাংসপেশী ঠিক রাখতে নিয়মিত ঘাড়ের ব্যায়াম করা।

চিকিৎসা

ডা. ফয়সাল বলেন, কারো ঘাড়ে অল্প ব্যথা হয় তাহলে ৫ থেকে ৭ দিনেই ব্যথার ওষুধ খেলেই সেরে যায় অনেক সময়।

কিন্তু ঘাড়ে ব্যথা যদি ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে না কমে তখন অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রচণ্ড ব্যথা হলে দেরি করা যাবে না। আর যদি ব্যথার সঙ্গে জ্বর থাকে, খাওয়ার অরুচি দেখা দেয়, ওজন কমে যায় অথবা ঘাড়ের ব্যথা কাঁধে এবং কাঁধ থেকে হাতে আসে তাহলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ঘাড়ের ব্যথা চিকিৎসার জন্য অর্থোপেডিক্স ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

Comments