২০২৩: ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন সময়
চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে বিক্রি কমে যাওয়ায় সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে দেশের ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) ব্যাপক অসুবিধায় পড়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কাঁচামাল ও পরিবহন খরচসহ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের মুনাফা কমেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
জামালপুর সদরের সফল হস্তশিল্প ব্যবসার পুরস্কার পাওয়া উদ্যোক্তা আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার দোকানের পণ্য বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
তিনি বলেন, 'এমন নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কম প্রয়োজনীয় পণ্য না কেনায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমে গেছে। ফলে উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।'
২০১৬ সালে জয়িতা পুরস্কার ও ২০১৯ সালে জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার বিজয়ী এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, 'উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় লোকসান বেড়েছে।'
তিনি জানান, প্রতি পিস পোশাক তৈরিতে আগে খরচ হতো প্রায় ৪০০ টাকা। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ৬০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে।
অন্যান্য উপকরণের দামও একইভাবে বেড়েছে। শ্রমিকদের মজুরি আগের ১৩০ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ২০০ টাকা হয়েছে।
রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান শাবাব লেদার'র স্বত্বাধিকারী মাকসুদা খাতুন ডেইলি স্টারকে জানান, মহামারির সময়ের তুলনায় গত বছর ব্যবসা খারাপ ছিল।
তিনি বলেন, 'আমরা চলমান ডলার সংকটসহ কাঁচামালের বেশি দাম ও এলসি খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে ২০২৩ সাল পার করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'এলসি খুলতে না পারায় গত বছর প্রায় ৬০ হাজার ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করতে হয়েছে। এটি আমাদের মতো ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় ধাক্কা।'
তার মতে, আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো দাম জানানোর পর কার্যাদেশ পেতে যে সময় লাগে এর মধ্যে উত্পাদন খরচ বেড়ে যায়। মুনাফা তো কমেই উল্টো লোকসানের ঝুঁকি বাড়ে।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের কার্যাদেশ বাতিল করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।'
গত এক বছরে সাধারণ চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট প্রায় ৪০ টাকা বেড়ে ১২০ থেকে ১৬০ টাকা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'কাঁচামালের অতিরিক্ত দামের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের প্রতিযোগিতার মুখে স্থানীয় রপ্তানিকারকদের পক্ষে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।'
ঢাকার পান্থপথে মনিরুল ইসলাম মুন্নার আছে গদি ও অন্যান্য বিছানার সামগ্রী বিক্রির দোকান। তিনি জানান, গত পাঁচ মাসে তার পণ্যের বিক্রি ৭০ শতাংশ কম হয়েছে।
তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পর চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সমাধান হলে আগামী দিনগুলো ভালো হবে বলে আশা করছেন তিনি।
একই এলাকার 'সাইদুর ফার্নিচার'র মালিক সাইদুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, গত বছর তার পণ্যের বিক্রি প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। অনেক লোকসান হওয়ায় তিনি পাঁচ আউটলেটের মধ্যে তিনটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
পরিস্থিতি এতটাই কঠিন যে পান্থপথের ডিসি ফরেন ফার্নিচার ও কাকন ফার্নিচারসহ কয়েকটি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২৫ শতাংশ আসে এসএমই খাত থেকে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সুমন্ত কুমার মোহান্ত সরকারি সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এর মধ্যে আছে প্রণোদনা প্যাকেজ ও উদ্যোক্তাদের বর্তমান সংকট থেকে বাঁচাতে উন্নত ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া।
তিনি বলেন, 'সরকারের উচিত এসএমইর উত্পাদন ও রপ্তানি বিপণন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং লজিস্টিকস ও কাস্টমসসহ রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করা।'
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসএমই খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।'
এই প্রেক্ষাপটে তিনি দেশে ইউটিলিটি পরিষেবাগুলোয় ভর্তুকি দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান যাতে এসএমই খাত বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে।
Comments