‘মনে হচ্ছে রাজার আমলের সেই উত্তরাধিকার প্রথা আবার ফিরে এসেছে’

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন

জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তার নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছেন, 'যদি আল্লাহ তায়ালা আমার পক্ষে থাকেন, তাহলে আপনাদের ভোটও লাগবে না।'

মঙ্গলবার বিকেলে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসমাবেশে এ মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে ছাড় পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামা মঞ্জু।

ভোটে থেকে বিজয়ের জন্য ভোটারের ভোট না চাওয়ার এই বক্তব্য নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে।

তারা বলছেন, এমনিতেই বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে তাদের ও সমমনা দলগুলো ছাড়াই আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে, সন্দেহ আছে। এমন পরিস্থিতিতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রার্থীদের এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ জনগণের সেই সন্দেহকেই সঠিক প্রমাণ করে।

বিষয়টি নিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, '(জেপি চেয়ারম্যানের) এই বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তাদের ক্ষমতার উৎস জনগণ না। এর উৎস অন্য কোথাও। অথচ তারা নিজেরাও মাঝে মধ্যে বলে থাকেন যে তাদের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ।'

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টার ভাষ্য, 'বক্তব্যে মনে হচ্ছে, রাজা-রাজড়াদের আমলের সেই উত্তরাধিকার প্রথা আবার ফিরে এসেছে। ব্যক্তির স্থানে এখন সেই জায়গা নিয়েছে দল। অথচ এই জায়গাটি পরিবর্তনের জন্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। এই যদি হয়ে থাকে তাহলে নির্বাচন করার তো কোনো দরকার নেই। তারা নিজেরাই সব ঠিক করুক।'

সুলতানা কামাল আরও বলেন, 'বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মকে ক্ষমতা কিংবা রাজনীতির হাতিয়ার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যেভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোটের কথা বলা হচ্ছে তাতে সেটাতো সংবিধানেরও লঙ্ঘন।'

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে প্রথম সংসদ সদস্য হন পিরোজপুর-১ আসন থেকে। পরের প্রতিটি নির্বাচনে তিনি পিরোজপুর-২ থেকে জেতেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে এবং ২০০১ সালে জেতেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।

গত তিনটি নির্বাচনে জোটের শরিকরা আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে নির্বাচন করলেও মঞ্জু তার দলের প্রতীক বাইসাইকেল নিয়েই লড়াই করেন। তবে এবার তিনি নৌকায় চড়েছেন লড়াইয়ের বাস্তবতা দেখে।

'এটা প্রমাণ করে, সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে, তেমন কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।'

মঞ্জুর বক্তব্যের বিষয়ে তোফায়েল আহমেদের অভিমত হলো, আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা 'বিশ্লেষণযোগ্য, মন্তব্যযোগ্য কোনো ইলেকশন না'। তিনি বলেন, 'উনি (মঞ্জু) আসলে ভোট আল্লাহর কাছে চাননি, চেয়েছেন শেখ হাসিনার কাছে।'

এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলছেন, 'যেখানে হিউম্যান ভ্যালুস, পলিটিক্যাল ভ্যালুস, কালচারাল ভ্যালুস, নর্ম এগুলো টোটালি না থাকে, সেখানে এসব রাজনীতি, নির্বাচনের ভিত্তি থাকে না।

'রাজনীতির যে গ্রাউন্ড, সেটা একটা ভ্যালু সিস্টেমের ওপর দাঁড়ানোর কথা। সেখানে রাজনীতিবিদদের একটা মোরালিটি থাকতে হবে। পুরো সোসাইটি একটা মোরালের ওপর দাঁড়ালে, নৈতিকতার ওপর দাঁড়ালে, ভ্যালু সিস্টেমের ওপর দাঁড়ালে ওখানে রাজনীতিটাও ঠিক হবে, সমাজনীতিও ঠিক হবে। এখন নৈতিকতা থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে; যেটাকে নিউমোরাল বলা যেতে পারে।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'এখন বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাজনীতি করলে তোমাকে মার খেতে হবে, জেলখানায় যেতে হবে। আমরা সবাই এটা জায়েজ করে নিচ্ছি। বিষয়টা এমন যে, আমি ক্ষমতায় আছি। সুতরাং আমি তো আমার কৌশল করবই। কৌশল করে তোমাকে জেলে নেব, আটকাবোই। তুমি তোমার কৌশল ঠিক করো।'

'ইলেকশনের আগে সরকার মনে করছে যে নির্বাচন করতে গেলে বিরোধীদের বাইরে রাখা যাবে না। তাই তাদের অ্যারেস্ট করে ফেললাম, সাজা দিয়ে ফেললাম বহু লোককে—এটা যেন জায়েজ। আমাদের ভ্যালু সিস্টেমের ইরোশন এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে এমন একটা পরিস্থিতিতে প্রশাসন, সুশাসন, রাজনীতি এগুলো কিছুই ঠিক থাকে না। এখন আমাদের ইলেকশনটা এইরকম একটা কালচারাল গ্রাউন্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। যে ন্যারেটিভসগুলো আমরা দিচ্ছি সেগুলো কোনোভাবেই একটা সাউন্ড ভ্যালু সিস্টেমকে রিপ্রেজেন্ট করে না। এ জায়গায় আমরা ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছি', যোগ করেন তিনি।

তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, 'আমরা একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছি। এখান থেকে কীভাবে বের হবো জানি না। এর শেষে কোনো আলো নেই।'

পিরোজপুর-২ আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী কানাই লাল বিশ্বাস সরে গেলেও মঞ্জুর সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দীন মহারাজ তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন।

পাশাপাশি ১৯৯১ সাল থেকে এই আসনে টানা জিতে আসা মঞ্জুর জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে আসন পুনর্গঠন।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বক্তব্য ধরে টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'সার্বিকভাবে সামনে যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে সেটা কতখানি অংশগ্রহণমূলক হবে, কতখানি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে, তা নিয়ে যে সন্দেহ জনমনে আছে এই বক্তব্য তারই প্রতিফলন।'

'অর্থাৎ এখানে ভোটের মূল্য নেই। ভোট কিংবা নির্বাচন শব্দগুলোর যে যথার্থতা তা এমন একটি পর্যায়ে চলে এসেছে, তাতে নির্বাচন শব্দটিরও যথার্থতা হারিয়ে যেতে বসেছে। অন্যদিকে মানুষের ভোটাধিকারের বিষয়টিও একেবারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।'

সেই ১৯৯১ সাল থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে আসা একজন রাজনীতিক ও একটি দলের প্রধান হয়েও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর এমন বক্তব্যের বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, 'এটা প্রমাণ করে, সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে, তেমন কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।'

এ পর্যায়ে সম্প্রতি ভোটে আসার শর্তে কারাবন্দি বিএনপি নেতাদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা নিয়েও কথা বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, 'আব্দুর রাজ্জাক সাহেব দলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন, তিনি একজন মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহার কমিটির প্রধান। তিনি তার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তবে সেখানেও কিন্তু একই জিনিস প্রতীয়মান হয়—জনগণের বাস্তব অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে যেখানে নির্বাচন হওয়ার কথা, সেখানে তা সিলেকশনের মতো হয়ে গেছে। ইলেকশন শব্দটা এখন কতটা প্রযোজ্য সেটা আমরা জানি না। বরং সিলেকশন শব্দটাই প্রযোজ্য। সেটা এ ধরনের বক্তব্যের ভেতর দিয়ে আরও বেশি প্রতিফলিত হচ্ছে।'

Comments