ভূমিকম্পের তথ্য দিচ্ছে কারা?

earthquake
প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

ভূমিকম্পের পর মানুষের আতঙ্ক যখন কিছুটা কমে আসে, তখন তারা এর কারণ সম্পর্কে জানতে চায়। দেরিতে হলেও সরকার যে তথ্য দেয়, তা আসলে সিসমোলজিস্ট বা ভূতত্ত্ববিদ প্রদত্ত নয়, আবহাওয়াবিদের দেওয়া।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরে ভূমিকম্প বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনো বিজ্ঞানী নেই এবং কখনোই ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) ভূমিকম্প বিষয়ে তথ্য জানানোর পরই সাধারণত আবহাওয়া অধিদপ্তর এ সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে।

এর কারণ, আবহাওয়া অধিদপ্তর ম্যানুয়ালি তথ্য সংগ্রহ করে এবং এসব তথ্য সঠিকভাবে বা দ্রুত ব্যাখ্যা করার মতো কোনো বিশেষজ্ঞ তাদের নেই।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮৪ সালের অর্গানোগ্রামে এ ধরনের কোনো পদ না থাকায় তারা কোনো সিসমোলজিস্ট বা ভূতত্ত্ববিদ নিয়োগ দিতে পারেননি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সংশোধিত অর্গানোগ্রামে এ ধরনের পদ রেখেছি। কিন্তু অর্গানোগ্রামটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।'

তিনি জানান, তাদের এমন কিছু আবহাওয়াবিদের সঙ্গে কাজ করা দরকার, যারা জাপানে ভূমিকম্পের বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

কেবল দুজন কর্মকর্তা বাংলাদেশে ভূমিকম্পের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন এবং তারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না।

যেকোনো উন্নত দেশে, এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও স্বয়ংক্রিয় মেশিন এবং মেসেজিং সেবা ব্যবহৃত হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ২ ডিসেম্বর পাঁচ দশমিক ছয় মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশের কিছু অংশ কেঁপে উঠলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন ভবন থেকে নামতে গিয়ে অন্তত ৭৬ পোশাকশ্রমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আহত হন।

এ বছর বাংলাদেশে প্রায় ১০০টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, যেগুলোর বেশিরভাগই তিন থেকে চার দশমিক পাঁচ মাত্রার ক্ষুদ্র কম্পন ছিল। ইউএসজিএস ও ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, এদের মধ্যে পাঁচটি ছিল পাঁচ বা তার বেশি মাত্রার।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যাখ্যার জন্য ম্যানুয়াল সিস্টেমের ওপর নির্ভর করায় ভূমিকম্প সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে তাদের সাধারণত ২০ মিনিটের মতো দেরি হয়।

তারা আরও জানান, কোথাও ভূমিকম্প আঘাত হানার পর তারা যে তথ্য পান তা একটি কম্পিউটারে ম্যানুয়ালি প্রদান করতে হয়, এরপর তারা সেই ভূমিকম্পের অবস্থান ও তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাঈয়্যাত কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বয়ংক্রিয় ফলাফল তৈরি করে এমন সফটওয়্যার থাকলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য দিতে পারব।'

তিনি জানান, তারা ভূমিকম্পের গভীরতা সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেন না, যা গুরুত্বপূর্ণ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, তথ্য সংগ্রহের কিছু সাইটে গুরুতর শব্দ সমস্যা আছে, যা ভূমিকম্পের গভীরতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। তা ছাড়া, ভূমিকম্পের গভীরতার তথ্য প্রদানে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আস্থার অভাব রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপ শনাক্তকরণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের অন্য কাজে লাগানো উচিত নয়।

তারা আরও বলেন, ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান নেই, এমন কর্মকর্তারা মেশিন দ্বারা প্রস্তুতকৃত তথ্যের ব্যাখ্যা করতে গেলে ভুল করতে বাধ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্প-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সেই তথ্য ব্যাখ্যা ও প্রচারের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে।'

'ভারতের নয়াদিল্লিতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি রয়েছে। বাংলাদেশে কাজটি বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগকে দেওয়া উচিত, যেখানে ভূতত্ত্ববিদ আছেন', বলেন তিনি।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার আরও বলেন, 'আবহাওয়া অধিদপ্তরই ভূতত্ত্ববিদ ও সিসমোলজিস্ট নিয়োগ দিতে পারে।'

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তথ্য সঠিকভাবে ব্যাখ্যার জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তরে অবশ্যই সিসমোলজিস্ট বা ইঞ্জিনিয়ারিং-সিসমোলজিস্ট থাকতে হবে।'

তিনি বলেন, 'তথ্য ব্যাখ্যার জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তর তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।'

ভারত ছাড়াও নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেও আলাদা সিসমিক সেন্টার রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যন্ত্রপাতি কেবল ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করতে পারে। তবে এর তীব্রতা সম্পর্কিত তথ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।'

'প্রতিটি এলাকার একটি নির্দিষ্ট তীব্রতা আছে। এসব তথ্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কোন এলাকায় কীভাবে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে, সে সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সহায়তা করে', বলেন তিনি।

ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ম্যানুয়াল সিস্টেম মানুষের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে। এতে ভূমিকম্পের কার্যকলাপ শনাক্তে বিলম্ব হতে পারে। স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম তাত্ক্ষণিক সতর্কবার্তা প্রদান করতে পারে। ফলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় পাওয়া যায়।'

তিনি বলেন, 'মানব অপারেটররা সিসমিক সিগন্যাল ব্যাখ্যা করতে ভুল করতে পারেন কিংবা আসন্ন ভূমিকম্পের সূক্ষ্ম লক্ষণ বুঝতে সক্ষম নাও হতে পারেন। অটোমেশন মানুষের ত্রুটির ঝুঁকি হ্রাস করে এবং আরও সঠিক ও নির্ভরযোগ্য শনাক্তকরণ নিশ্চিত করে।'

'ম্যানুয়াল সিস্টেমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা যায় না। ফলে ভূমিকম্পের কার্যকলাপও সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায় না', যোগ করেন তিনি।

মোহন কুমার দাশ বলেন, 'ম্যানুয়াল সিস্টেমে জরুরি সেবায় তথ্য আদান-প্রদানে মানুষের ওপর নির্ভর করা হয়, যা জরুরি প্রতিক্রিয়া প্রদানে বিলম্বের সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে একটি দুর্যোগের পর যখন যোগাযোগ অবকাঠামো ভেঙে পড়ে, তখন প্রত্যেকে তার প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাতেই ন্যস্ত থাকে।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং দক্ষ বিশেষজ্ঞ জনবলের উল্লেখযোগ্য অভাব রয়েছে। আসন্ন ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রকৃত বিজ্ঞানী, গবেষক ও ভূ-বিপর্যয় বিশেষজ্ঞদের অনুপ্রাণিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

জনবল ঘাটতি

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রে মাত্র দুজন কর্মকর্তা আছেন।

কর্মকর্তারা জানান, সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়। অফিস চলাকালীন সময়ের বাইরে যদি ভূমিকম্প হয়, তাহলে সে সম্পর্কে আপডেট দিতে তাদের কারও একজনকে অফিসে যেতে হবে। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের অন্তত ছয়জন কর্মকর্তা প্রয়োজন।

২০০৭ সালে চালুর পর থেকে এই গবেষণা কেন্দ্র কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেনি।

কেন্দ্রের প্রধান রুবাঈয়্যাত কবির বলেন, 'আমরা কখন গবেষণা করব? আমরা মাত্র দুজন মানুষ। আমাদের অফিসের কাজ করা উচিত নাকি গবেষণা? এটা কি সম্ভব?'

রুবাঈয়্যাত কবিরসহ কমপক্ষে ছয়জন কর্মকর্তা জাপানে ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন কেবল রুবাঈয়্যাত কবিরই এই কেন্দ্রে কাজ করছেন।

ভূমিকম্প-সংক্রান্ত কার্যকলাপের তথ্য সংগ্রহের জন্য সারাদেশে ১৩টি সিসমোমিটার রয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

4h ago